[ অনলাইন ] 2025-04-18 |
|
|
|
মিরসরাই জাতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল |
দৃশ্যমান বিনিয়োগ যৎসামান্য, বড় পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা
|
|
|
দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল মিরসরাই জাতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল, যার আয়তন প্রায় ৩৪ হাজার একর। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বাস্তবায়নাধীন এ উন্নয়নের ধারায় উঠেছে অনেক অভিযোগ। বিনিয়োগ প্রকল্প সচল রাখতে মিলছে না চাহিদা অনুযায়ী পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের নিশ্চয়তা। সর্ববৃহৎ এ শিল্প কর্মযজ্ঞে তাই দৃশ্যমান বিনিয়োগ যৎসামান্য। এখনো গড়ে ওঠেনি উল্লেখযোগ্য শিল্প-কারখানা। তেমন ভূমিকা রাখতে পারেনি কর্মসংস্থানেও। অন্যদিকে উপকূলীয় বনাঞ্চল দখল করায় বিপন্ন হচ্ছে প্রাণিকুল। ফলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয়েছে বেশি। বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনা হয়েছে সামগ্রিক পরিবেশে।
মিরসরাইয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজ হাতে নেয়া হয় ২০১২ সালে। চট্টগ্রামের সর্ব উত্তরের উপজেলা মিরসরাই ও ফেনীর সোনাগাজীসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপ চ্যানেল উপকূলবর্তী চরের ৩৩ হাজার ৮০৫ একর জমির মধ্যে নির্মাণ হচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ এ শিল্পাঞ্চল। এর মধ্যে বনের জমি রয়েছে ২২ হাজার ৩৩৫ একর। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্বার্থে সৃজিত ও প্রাকৃতিক বনসমৃদ্ধ বিপুল এ জমি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) কাছে হস্তান্তর করেছিল বনবিভাগ। অথচ এ বনে রয়েছে উপকূল রক্ষার বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ছাড়াও নানান প্রাণবৈচিত্র্য। অবকাঠামো উন্নয়নের স্বার্থে এরই মধ্যে এ বনের সাড়ে ১৩ লাখ গাছ কাটা হয়েছে। বিলুপ্ত কিংবা অন্যত্র সরে গেছে প্রাণিকুলও।
শিল্প উৎপাদন খাতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের উচ্চাভিলাষী এ প্রকল্পের প্রয়োজনে ছাড় দেয়া হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ উপকূলীয় বনের সুরক্ষা কাঠামো। শিল্পাঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণের পর অবশ্য ১৯ হাজার ৯৪৫ একর জমি বনায়ন, খোলা স্থানসহ শিল্পবহির্ভূত কাজে ব্যবহারের কথা ছিল। তবে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বাস্তবায়নের অপেক্ষায় থাকা অগ্রাধিকার প্রকল্পটিতে উল্লেখযোগ্য লক্ষ্য অর্জন হয়নি। প্রতিশ্রুতির দৃশ্যমান বাস্তবায়ন না হওয়ায় অরক্ষিত হয়ে পড়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সীমান্তবর্তী উপকূলের বনটিও। এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বড় ধরনের ক্ষতির ঝুঁকিও বাড়ছে। inner lead
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে বৃহৎ শিল্পাঞ্চল নির্মাণে ভূমির অপ্রতুলতার কারণে উপকূলীয় চরকে বেছে নেয়া হয়েছিল। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সন্নিকটে এবং চট্টগ্রাম বন্দর ও রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ সুবিধার কারণে মিরসরাই ও ফেনীতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ছিল বেজার। এতে বিপুল পরিমাণ দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের পাশাপাশি নির্মাণাধীন রামগড় স্থলবন্দরের মাধ্যমে ভারতের বিনিয়োগও প্রত্যাশা ছিল।
দেশের প্রধান অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণে সরকারের অগ্রাধিকার দেয়া সত্ত্বেও বাস্তবায়নে ধীরগতির একাধিক কারণ দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। বিগত এক দশক ধরে দেশে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতায় প্রচারণা সত্ত্বেও বিনিয়োগ আসেনি। বিশ্ববাজার থেকে এলএনজি আমদানির মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ দেয়া হলেও চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাসের সংকট এখনো তীব্র। তাছাড়া মেগা শিল্পাঞ্চল স্থাপনের উদ্যোগের পাশাপাশি সেখানে পানির সরবরাহের কোনো সুরাহা করতে পারেনি সরকারি কোনো সংস্থা। শুরুতে চট্টগ্রাম ওয়াসার মাধ্যমে হালদা নদী থেকে পাইপলাইনে পানি সরবরাহ করার কথা ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র স্বাদু পানির মাছের প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদী থেকে নতুন প্রকল্পে পানি উত্তোলনের বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদে সেটিও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ফলে মুহুরী প্রজেক্টসহ ফেনী নদী থেকে পানি উত্তোলন, পরিশোধ করে জাতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলে সরবরাহের পরিকল্পনা করা হলেও সেটি এখনো অনিশ্চিত, যা অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থায়ী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীদের অনেকে।
বাংলাদেশ ইকোনমিক জোনস ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশনের (বিইজেডআইএ) সভাপতি এমএ জব্বার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ অঞ্চলটির পরিকল্পনার শুরুতেই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজটি যথাযথভাবে করা উচিত ছিল। পানি থেকে শুরু করে সব ধরনের বিনিয়োগ অবকাঠামো যাতে করে প্রস্তুত থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি। ওখানে বড় একটা সমস্যা হলো পানি। এছাড়া বিদ্যুতের বিষয়ও রয়েছে। পিজিসিবি একটা সাবস্টেশন করেছে, কিন্তু শুধু সাবস্টেশন দিয়ে তো আর হবে না। সড়কও প্রয়োজন হবে। এছাড়া আইন-শৃঙ্খলাও একটা বড় সমস্যা। এক্ষেত্রে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যকারিতা নিশ্চিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সহায়তা অত্যন্ত জরুরি। অর্থায়নও একটা চ্যালেঞ্জ। বেজার নিজস্ব কোনো অর্থায়ন ব্যবস্থা নেই। যতটুকু ছিল তা জমি বরাদ্দ নিতে গিয়েই শেষ হয়ে গেছে। এ অঞ্চলের সম্ভাব্যতা যাচাইও যথাযথভাবে হয়নি। হলে পানির চাহিদা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকত। যতদূর জানতে পেরেছি বেজার হালনাগাদ পরিকল্পনা অনুযায়ী মিরসরাইয়ের প্রকল্পটির কলেবর কমিয়ে আনা হচ্ছে।’
বন বিভাগ বলছে, মিরসরাই থেকে ফেনী পর্যন্ত প্রায় ১৩৬ দশমিক ৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে জাতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলের সীমানা। মিরসরাই থেকে ফেনী পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে সরু অঞ্চলও এটি। একদিকে বঙ্গোপসাগর ও অন্যদিকে ভারত। ফলে মানুষ ও সম্পদের পাশাপাশি বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সুরক্ষায় উপকূলীয় বন গুরুত্বপূর্ণ। উপকূলীয় বন উজাড় করা হলে সমুদ্রের ভাঙনের ফলে দেশের লাইফলাইন খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এজন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল চালুর পাশাপাশি উপকূলীয় বন রক্ষা, নতুন করে বন সৃজন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বন কর্মকর্তারা।
অর্থনৈতিক অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে আনুমানিক ৪ হাজার ১০৪ একর জায়গায় বন বিভাগ সৃজিত ও প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া গেওয়া, কেওড়া, হারগোজাসহ নানা প্রজাতির লতাগুল্মের ঘন বন গড়ে ওঠে। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এ বনে হরিণ, শিয়াল, মেছোবাঘ, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, সামুদ্রিক পাখি, জলচর পাখিসহ অন্যান্য প্রাণীর বসবাস রয়েছে। এ কারণে বন বিভাগ দ্রুত সময়ের মধ্যে এ জমিগুলো ফেরত নিতে চাইছে।
বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বেজার অনুকূলে বরাদ্দ দেয়া ভূমি থেকে ৪ হাজার ১০৪ একর অব্যবহৃত ভূমি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দেন। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২২ ডিসেম্বর দেয়া ওই চিঠিতে জানানো হয়, দ্রুত সময়ের মধ্যে বনটি ফেরত নেয়া হলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য তৈরি হবে।
অর্থনৈতিক অঞ্চলের বন রক্ষায় একটি প্রস্তাব জমা দিয়েছেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক ড. মোল্যা রেজাউল করিম। গত ১৪ জানুয়ারি দেয়া আটটি প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে ৪ হাজার ১০৪ একর জমিতে বিদ্যমান গাছপালা সংরক্ষণ, অর্থনৈতিক অঞ্চলে কেটে ফেলা গাছের বিকল্প হিসেবে পশ্চিম অংশে সুপারডাইকে ঝাউবাগান সৃজন, অর্থনৈতিক অঞ্চলের খালগুলোর দুই পাড়ে বনায়ন, কারখানাগুলোর খালি স্থানে বনায়ন।
যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য যে পরিমাণ বনভূমি বরাদ্দ নেয়া হয়েছে তার অনেক অংশই ব্যবহার হচ্ছে না। অর্থনৈতিক স্বার্থে শিল্পাঞ্চল নির্মাণ করতে হবে এটা যেমন সত্য, তেমনি উপকূল কিংবা বনও রাখতে হবে। আমরা উপকূল রক্ষা, বন সৃজন করতে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের জমি ফেরত চেয়েছি। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে অব্যবহৃত জমিতে বন সৃজনের মাধ্যমে মিরসরাই-ফেনীর উপকূল সুরক্ষায় কাজ শুরু করা সম্ভব হবে।’
বেজা সূত্রে জানা গেছে, জমি বরাদ্দের জন্য ২০১৭ সালের এপ্রিলে আবেদন নেয়া শুরু হয়। ২০১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালে বেজা ১ হাজার ১৩৮ দশমিক ৫৫ একর জমি বুঝিয়ে দিলে এতে ৫৩৯টি প্লট তৈরি করে বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ কর্তৃপক্ষ (বেপজা)। সর্বশেষ ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪১টি প্রতিষ্ঠানকে কেবল ২৪৪টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে উৎপাদনে যাওয়া তিনটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান খাইশি লিনজেরি বাংলাদেশ লিমিটেড, কেপিএসপি সুজ বাংলাদেশ ও পেংকুইনে আড়াই হাজারের মতো কর্মসংস্থান হয়েছে। উৎপাদনের অপেক্ষায় থাকা তিন প্রতিষ্ঠান হলো মিনতা বাংলাদেশ, গুড উড ঢাকা ও ইয়াংচেন বিডি। দেশে বেপজার নয়টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বড় জাতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাটি। বর্তমানে এখানে ৯২৩ দশমিক ১৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে জমি বরাদ্দ নিয়েও যথাসময়ে কাজ শুরু না করায় কাজী ফার্মস, কেবি পেট্রো কেমিক্যাল ও এইচ কেন্ডি নামের তিনটি প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশ বাতিল করেছে বেপজা। সব মিলিয়ে আবেদন আহ্বানের আট বছর পেরিয়ে গেলেও মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনে আসায় ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান পরিকল্পনা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
বেজা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিকল্পিত অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় প্রায় ৩৪ হাজার একর জমির যে পরিমাণটি বলা হতো সেটা অনেকটা ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার মতোই অবাস্তব। সেই অবাস্তব পরিকল্পনা থেকে অন্তর্বর্তী সরকার সরে এসেছে। জমির কলেবর কমছে। আবার আগের পরিকল্পনায় অনেক ধানি জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা ছিল, সে পরিকল্পনায়ও পরিবর্তন এসেছে। আর আগের মতো ঢালাওভাবে অর্থনৈতিক অঞ্চল সম্পন্নের কাজও এখন আর হাতে নেয়া হচ্ছে না। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে ধাপে ধাপে পর্যায়ক্রমে অর্থনৈতিক অঞ্চলটির কাজ এগিয়ে নেয়া হবে।
এ বিষয়ে বেজার নির্বাহী সদস্য অতিরিক্ত সচিব সালেহ আহমদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মিরসরাইয়ে এখন পর্যন্ত ১৭ হাজার একরের মতো জমি আমরা বুঝে পেয়েছি। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী অঞ্চলটি ২১ হাজার একরের ওপর করা হবে। আগের পরিকল্পনায় পুরনো বেড়িবাঁধসংলগ্ন ইছাখালির কিছু জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব ছিল। তবে সেগুলো সবই ধানি জমি। বর্তমান পরিকল্পনায় সেগুলো আর অধিগ্রহণ করা হবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রাণিকুল বিপন্নের বিষয়টি শুধু কথার কথা বলে আমি মনে করি। যতদূর শুনেছি কিছু বনবিড়াল, কাঠবিড়ালি ছিল, স্থানীয় কেউ কেউ বলেন কিছু হরিণও ছিল। মিরসরাইয়ে অনেক প্রাণিকুল বিপন্ন হয়েছে এবং ম্যানগ্রোভ নষ্ট হয়ে গেছে—এ ধরনের অভিযোগ পুরোপুরি সঠিক নয়। আমরা নিজস্ব উদ্যোগেও বেশকিছু এলাকাজুড়ে বনায়ন করেছি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। আমি মনে করি মিরসরাইয়ে আমরা বন বা পরিবেশ ধ্বংস করিনি। কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, যেটাকে বলা যায় বিনির্মাণ।’
সালেহ আহমদ আরো বলেন, ‘নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে অর্থনৈতিক অঞ্চলটি প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছি আমরা। ভবন বা স্থাপনা নির্মাণে যে পরিমাণ পানি ও বিদ্যুৎ প্রয়োজন, তা আমরা এখনই দিতে পারব। আর উৎপাদন পর্যায়ের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ ও পানি সংস্থানের প্রস্তুতিও আমাদের রয়েছে। তবে ২১ হাজার একর জমি মাটি ভরাটের কাজেই প্রয়োজন দুই থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকা, যা রাতারাতি করাটা ফিজিবল না। এ কারণেই সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে নির্বাহী চেয়ারম্যান (আশিক চৌধুরী) জানিয়েছিলেন, এনএসইজেডের চারটি জোনকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত অবস্থায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে আগামী তিন বছরের মধ্যে।’
বেজার অধীনে নেয়ার পর বনভূমির গাছপালা কেটে বহুতল ভবন, কলকারখানা, রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করছে। ৪ হাজার ১০৪ একর বনের জমি ফেরত দেয়া প্রসঙ্গে সালেহ আহমেদ বলেন, ‘এ বিষয়ে একটি চিঠি পেয়েছি। তাতে যে দখলের কথা বলা হয়েছে, সেটা আসলে দখল না, জমিটা সরকারি। সেখানে এরই মধ্যে অনেক কাজ হয়েছে, সড়ক উন্নয়ন হয়েছে, কিছু জমি লিজ দেয়া হয়েছে, এখন সেসব জমি ফেরতের বিষয়টি সরকারের সিদ্ধান্ত। সরকার যদি মনে করে ওই জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং শিল্প না করে বন বিভাগকে ফেরত দেবে, সেটা দিতেই পারে।’
উপকূলীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের জন্য মিরসরাই উপজেলার সাহেরখালী, ইছাখালী ও মঘাদিয়া ইউনিয়নের উপকূলীয় অঞ্চলের ২২ হাজার ৩৩৫ একর বনাঞ্চল নিয়ে নেয় বেজা। এসব বনাঞ্চলে গেওয়া, বাইন কেওড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ছিল। আরো ছিল হরিণ, শিয়াল, মেছোবাঘ, লজ্জাবতী বানর, বেজি, সাপসহ বিভিন্ন ধরনের বন্য প্রাণী। ভারী অবকাঠামো নির্মাণে উপকূলীয় বনগুলোর সিংহভাগ ধ্বংস হওয়ায় বন্য প্রাণীও কমছে। বিশেষ করে হরিণের সংখ্যা কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। একসময় মিরসরাই উপকূলীয় বনে ১০ হাজারের বেশি হরিণ থাকলেও বর্তমানে তা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। বন উজাড় হওয়ায় অন্যত্র চলে যাওয়ার সময় প্রায়ই সড়কে যানবাহনের আঘাতে, জলোচ্ছ্বাস কিংবা ঘূর্ণিঝড়ে হরিণের মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এমনকি শিকারিদের হাতেও মারা পড়ছে মিরসরাই উপকূলীয় বনের হরিণ।
জানতে চাইলে মিরসরাই উপকূলীয় রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল গফুর মোল্লা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মিরসরাইয়ে অবস্থিত জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য দেয়া বনে কেওড়া, গেওয়া, বাইনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ছিল। বিভিন্ন বন্য প্রাণীর মধ্যে হরিণের সংখ্যাই ছিল বেশি। বনাঞ্চল কমে আসায় হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণীও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলের অবকাঠামো নির্মাণ, বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে হরিণসহ অন্যান্য প্রাণিকুলের সংখ্যা অস্বাভাবিক কমে গেছে।’
বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ৪ হাজার ১০৪ একর জায়গায় এখনো গাছপালা রয়েছে বলে মাঠ পর্যায় থেকে প্রতিবেদন দিয়েছে বন বিভাগ। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক শেখ আবুল কালাম আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মিরসরাইয়ের এ বনে হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণীর উপস্থিতি ছিল। এটি ইকোসিস্টেমের অংশ। খাদ্য যখন বেশি থাকবে বন্য প্রাণীও বেশি থাকবে। এখন বন কমে গেছে, হরিণও কমে গেছে। আমরা মিরসরাই ও সীতাকুণ্ডে এক-দেড় হাজার একর নতুন বন সৃষ্টি করেছি। আমরা যদি এ বন রক্ষা করতে পারি, আবারো হরিণের বাসস্থান ফিরিয়ে আনতে পারব।’ |