[ Online ] 2025-04-18
 
ভ্যাটের একক হার নির্ধারণে হিসাব কষছে এনবিআর
 
ফারজানা লাবনী

আগামী অর্থবছরের বাজেটে বহু স্তরবিশিষ্ট ভ্যাট (ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স) বা মূসক (মূল্য সংযোজন কর) হারের পরিবর্তে একক হার নির্ধারণে হিসাব কষছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে এটি করছে প্রতিষ্ঠানটি।

এনবিআর-সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন, ভ্যাটের একক হার নির্ধারণ করা হলে ভ্যাট আদায় কয়েক গুণ বাড়বে, ফাঁকি কমবে। ভ্যাট আদায়ের হিসাব করাও সহজ হবে।

অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলেছেন, ভ্যাটের একক হার নির্ধারণ করা হলে অনেক ক্ষেত্রে কম হারের ভ্যাট বাতিল হয়ে যাবে। এসব খাতে উচ্চহারের ভ্যাট আরোপ হবে। এতে অনেক পণ্য ও সেবা খাতের খরচ বেড়ে যাবে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাকেই পরিশোধ করতে হবে।

এনবিআরের এ প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ প্রস্তাবের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে খতিয়ে দেখবেন। উপদেষ্টা পরিষদ থেকে এনবিআরের এ প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হতে পারে। অনুমোদন না দিয়ে সংশোধন করা বা বাতিল করাও হতে পারে।

এনবিআরের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বর্তমানে বেশির ভাগ পণ্য ও সেবা খাতে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট হার ধার্য করা আছে। এসব হার বাতিল করে একক হার নির্ধারণ করা হলে ভ্যাট খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আদায় কয়েক গুণ বাড়বে। ভ্যাট ফাঁকি কমবে। ভ্যাট আদায়ের হিসাব করা সহজ হবে। ভ্যাটের একক হার ১০ শতাংশের কম ও ১৫ শতাংশের বেশি হবে না। অর্থাৎ ভ্যাটের হার ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫ শতাংশ- যেকোনো একটি হার নির্ধারণ করা যেতে পারে।

এনবিআর চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, ভ্যাট রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে বড় খাত। ভ্যাট আদায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে বর্তমানে যে পরিমাণ ভ্যাট আদায় হয় তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি আদায় হবে। এর জন্য ভবিষ্যতে ভ্যাট আদায়ে একক হারের দিকেই যেতে হবে। এ জন্য অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ভ্যাটের একক হার নির্ধারণ করা নিয়ে অনেক আগে থেকেই আলোচনা চলছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়সংক্রান্ত বিষয়ে বড় ধরনের সংস্কার করা হবে। সংস্কারের অংশ হিসেবে ভ্যাটের একক হার নির্ধারণ করা হলে ভ্যাট আদায়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। প্রযুক্তির সাহায্যে ভ্যাট আদায় সহজ হবে। তবে মনে রাখতে হবে, এ হার যেন একক সংখ্যায় হয়।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. আবুল বাশার মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ভ্যাট আইন, ২০১২তে একক ভ্যাটের হার রাখা হয়েছিল। এটি মূলত আইএমএফের সুপারিশ ছিল, যা তৎকালীন সরকার বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দাবির মুখে বাধ্য হয়েছিল বাদ দিতে।

অর্থনীতির এ বিশ্লেষক বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন হারে ভ্যাট নির্ধারণ করা হয়েছে। কম হারের ভ্যাট বাতিল করে বেশি হারের ভ্যাট ধার্য করা হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট খাতে ভ্যাট বাড়বে।

তিনি আরও বলেন, ভ্যাট যোগ করে পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়। অনেক ভোক্তা পণ্যমূল্যের কতটা ভ্যাট, তা না জেনেই পণ্যের দাম হিসেবে পরিশোধ করে থাকেন। তাই ভ্যাট বাড়লে দামও বাড়বে। ভোক্তাকেই বাড়তি দাম দিতে হবে। তাই সব খাতেই ভ্যাটের একক হার ১৫ শতাংশ হলে তা অনেকের জন্য অনেক বেশি হবে। ভ্যাটের একক হার অবশ্যই কম হতে হবে।

এনবিআর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিগারেট, মোবাইল ফোন, তেল ও গ্যাস, গাড়ি, সিমেন্ট, ব্যাংকসহ বড় কয়েকটি খাতে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ ভ্যাট কার্যকর আছে। মোট আদায় করা ভ্যাটের প্রায় ৮০ শতাংশই আসে এসব খাত থেকে। এসব খাতের বাইরেও আরও কিছু খাতে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ ধার্য করা আছে। এর বাইরে কিছু পণ্যের ওপর নির্দিষ্ট অঙ্কের ভ্যাট দিতে হয়, যা স্পেসিফিক ট্যাক্স নামে পরিচিত। অনেক খাতে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ ধার্য থাকলেও ভ্যাটের আপতন কমে ১৩ শতাংশ হয়। ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ বা ৭ শতাংশ ধার্য থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে কমে যায়। এভাবে যা নির্ধারণ করা থাকে, তারচেয়ে পরিশোধ করা ভ্যাটের হার অনেক সময় কম হারে পরিশোধ করতে হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সুপারিশে রাজস্ব খাতের সংস্কার করা হবে এমন শর্ত মেনেই দাতা সংস্থাটি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে। আইএমএফের সংস্কারের মধ্যে ভ্যাটের একক হার ১৫ শতাংশ নির্ধারণের কথা বলা আছে। আইএমএফ থেকে চার বছরে ৬ লাখ ৩৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা মূসক বা ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে গত বছর ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা, ২০২৪ সালে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, ২০২৫ সালে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা ও ২০২৬ সালে ২ লাখ ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ভ্যাট আদায় করার জন্য বলা হয়েছে।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, আইএমএফ এনবিআরের ওপর রাজস্ব আদায় বাড়ানোর চাপ দিয়েছে। তারা লক্ষ্যমাত্রাও দিয়ে দিয়েছে। এনবিআর আদায় বাড়ানোর জন্য ভ্যাটের একক হার নির্ধারণের পথে হাঁটলে আদায় বাড়বে। তবে এটা ঠিক যে একক হার কার্যকর হলে অনেক পণ্য ও সেবা পেতে হলে বেশি খরচ করতে হবে, যা ভোক্তাকে পরিশোধ করতে হবে। এটি ধনী ব্যক্তিদের জন্য সমস্যা না হলেও সাধারণ আয়ের মানুষ চাপে পড়বেন।

তিনি আরও বলেন, ভ্যাটের আওতা বাড়ানো সম্ভব হলে আদায় কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। ভ্যাটের হার কত হবে, তা নিয়ে এনবিআরকে ভাবতে হতো না। তাই ভ্যাটের আওতা বাড়াতে গুরুত্ব বাড়াতে হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের বাজেট প্রস্তুত কমিটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, অনেক সময় বেশি হারে ভ্যাট থাকলেও ব্যবসায়ীরা মিথ্যা তথ্য দিয়ে কম হারে ভ্যাট পরিশোধ করে থাকেন। এভাবে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার ভ্যাট বঞ্চিত হচ্ছে। এনবিআর একক হারে ভ্যাট নির্ধারণ করতে পারলে ভ্যাট ফাঁকি কমে যাবে। অতীতেও এ চেষ্টা করা হয়েছে, তবে অনেক ব্যবসায়ীর বাধার কারণে তা সম্ভব হয়নি।
Print Close  
Print Close  
News Source
            Top
            Top
 
Home / About Us / Benifits /Invite a Friend / Policy
Copyright © Hawker 2009-2010, Allright Reserved