[ পাতা ১ ] 2025-07-02 |
|
|
|
|
বন্দর কর্তৃপক্ষের সহায়তায় ৬ মাস পরিচালিত হবে নিউমুরিং টার্মিনাল
|
|
|
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনায় নতুন করে অপারেটর নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন ছয় মাসের জন্য সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছে সরকার।
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনায় নতুন করে অপারেটর নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন ছয় মাসের জন্য সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এজন্য মাসিক ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা হারে ছয় মাসে মোট ৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে ক্রয় কার্যক্রম অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি অনুমোদন করেছে।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে গতকাল এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সুলতানা সালেহা সুমী স্বাক্ষরিত এ চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, সরকারি ক্রয় আইন ২০০৬-এর ৬৮ ধারা অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ও সংশ্লিষ্ট ওভারফ্লো ইয়ার্ড পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন অপারেটর নিয়োগে অনুমোদন দিয়েছে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি। সরকারি ক্রয় আইন অনুযায়ী দ্রুত সময়ের মধ্যে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতির যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে এনসিটি পরিচালনার পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য বন্দরকে নির্দেশনাও দেয়া হয় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।
নাম না প্রকাশের শর্তে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এনসিটির বর্তমান চুক্তির মেয়াদ আগামী ৬ জুলাই শেষ হবে। পরবর্তী অপারেটর নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত ছয় মাস মেয়াদে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে এনসিটির কার্যক্রম পরিচালিত হবে। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি এ সিদ্ধান্ত দিয়েছে। আজ (মঙ্গলবার) অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কমিটির সভায় এটা অনুমোদিত হয়েছে।’
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত ও কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ কনটেইনার হ্যান্ডলিং টার্মিনাল। এখানে বেসরকারি অপারেটরের মাধ্যমে গত ১৭ বছর কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। ৬ জুলাই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই টার্মিনালের স্থানীয় অপারেটর পরিবর্তন বা বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এনসিটি (নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল) পরিচালনার ভার স্থানীয় অপারেটর থেকে নিয়ে নেয়া হচ্ছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, এরই পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সরঞ্জামসহ এনসিটির পুরো কার্যক্রম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে নেয়া এবং তাদের সহায়তায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী কর্তৃক পরিচালনার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে।
জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানো, স্থানান্তরসহ সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল এনসিটি। এখানে চারটি জেটিতে সমুদ্রগামী জাহাজ ভেড়ানো হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, এনসিটির বর্তমান চুক্তির মেয়াদ ৬ জুলাই শেষ হওয়ার পরই এ জেটিগুলো হস্তান্তর প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ হস্তান্তর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গতকাল বিকালে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন বর্তমান অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের প্রতিনিধিও।
সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আজ (মঙ্গলবার) বন্দরের চেয়ারম্যান মহোদয়ের সভাপতিত্বে এক সভায় আমি নিজেও যুক্ত হয়েছিলাম। বন্দর আমাদের অ্যাসেট ব্যবহার করতে চায়। এটা অনেক বড় অপারেশনাল কার্যক্রম। এখানে প্রচুর ইনভেস্টমেন্ট আছে, এখন আমাদের এ ম্যানেজমেন্ট তারা কীভাবে ব্যবহার করবেন সেটি নিয়ে মূলত আলোচনা চলছে। তবে আমি পরিষ্কারভাবে জানিয়েছি, যে কোনো কারণেই হোক এনসিটির অপারেশন কার্যক্রম ১ মিনিটের জন্যও বাধাগ্রস্ত হবে না। এ বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে কর্তৃপক্ষকে নিশ্চয়তা দিয়েছি।’
এর আগে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের কাছ থেকে ফিরিয়ে নিতে চিঠি দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে চুক্তির মেয়াদ ৬ জুলাই ২০২৫ শেষ হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়, ওই মেয়াদ শেষে টার্মিনালের যাবতীয় কার্যক্রম, বন্দরের ইকুইপমেন্ট এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের গঠিত কমিটির কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এনসিটির বর্তমান চুক্তির মেয়াদ ৬ জুলাই শেষ হবে। ফলে হস্তান্তর প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, পরিকল্পিত ও সময়মতো বাস্তবায়ন না হলে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। তাই বন্দরের পরিচালন কার্যক্রমে কোনো ধরনের ব্যাঘাত যাতে না ঘটে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করছে কর্তৃপক্ষ।’
চট্টগ্রাম বন্দরের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, অন্তর্বর্তীকালে বন্দর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী দেশের সবচেয়ে বড় এ টার্মিনালটি পরিচালনা করবে। বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, এনসিটির মতো গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনালগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ বন্দরের সক্ষমতা প্রমাণের একটি বড় পরীক্ষা হিসেবে দেখা যেতে পারে।
প্রিমিয়ার সিমেন্ট পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বর্তমান রূপান্তর প্রক্রিয়া কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।’
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, এনসিটি বা নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বাংলাদেশের অত্যাধুনিক ও ব্যস্ততম টার্মিনাল। জাহাজ থেকে বছরে ১০ লাখ এককেরও বেশি কনটেইনার ওঠানো-নামানোর ক্ষমতা রয়েছে টার্মিনালটির। আওয়ামী লীগ আমলে এনসিটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে ছেড়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়, যে পরিকল্পনায় আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরী যুক্ত ছিলেন বলে জোরালো গুঞ্জন ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও এ প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার বা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছে বিশ্বব্যাংকের সহযোগী ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)।
৯৫০ মিটার লম্বা নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে একসঙ্গে চারটি সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ ভিড়তে পারে। এখানে চট্টগ্রাম বন্দরের মোট কনটেইনারের ৪০ শতাংশের বেশি ওঠানো-নামানো হয়। ২০০৭ সাল থেকে আংশিক এবং ২০১৫ সাল থেকে পুরোদমে এ টার্মিনালে জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানো হচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ এতদিন দেশীয় প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডকে দিয়ে এ টার্মিনাল পরিচালনা করিয়েছে। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির নিয়োজিত শ্রমিক ছাড়াও কাজ করেছেন বন্দরের কর্মচারীরা। সব মিলিয়ে এ টার্মিনালে জেটি ও যন্ত্রপাতি খাতে চট্টগ্রাম বন্দরের বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বিদেশী অপারেটরকে টার্মিনালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হলে সেখানে নতুন বিনিয়োগ হবে। বিনিময়ে বন্দরকে কনটেইনারপ্রতি নির্ধারিত অংকের অর্থ দেবে এবং এতে বন্দরের দক্ষতা বাড়বে। তবে বিদেশী অপারেটর নিয়োগ পরিকল্পনার বিরোধিতাকারীদের যুক্তি হলো বন্দর যেহেতু কৌশলগত স্থাপনা, সেজন্য এনসিটিকে বিদেশী বিনিয়োগ ও পরিচালনায় ছেড়ে দেয়ার আগে সিদ্ধান্তটি নিয়ে রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে জনগণের মতামত প্রয়োজন। |