[ পাতা ১ ] 2025-07-09
 
ট্রাম্পের ৩৫% শুল্ক আরোপের চিঠি ড. ইউনূসকে
পোশাকশিল্পে অশনিসংকেত
 
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর শেষ পর্যন্ত ৩৫ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট। ১ আগস্ট থেকে এটি কার্যকর হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার চিঠি দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বিষয়টি জানিয়েছেন।

এদিকে অতিরিক্ত এ শুল্কহার কার্যকর হলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে দেশের পোশাকশিল্পসহ রপ্তানি খাত। বিশেষ করে পোশাক খাতে বড় ধরনের অশনিসংকেত দেখা দিতে পারে। কারণ, ট্রাম্প প্রশাসনের এ পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অনেকটা কমিয়ে দেবে। যুক্তরাষ্ট্র হলো বাংলাদেশের পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় বাজার। এছাড়া এর প্রভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এমনটিই মনে করেন বিশেষজ্ঞ ও পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা।

যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল থেকে আশা প্রকাশ করে বলা হচ্ছে, এ শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এখনো আলোচনা অব্যাহত আছে। আজ আরেক দফা আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের (ইউএসটিআর) সঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বৈঠক করবেন। এছাড়া নতুন শুল্কহার নিয়ে ১০, ১১ ও ১২ জুলাই ইউএসটিআর-এর সঙ্গে নিগোসিয়েশন বৈঠক রয়েছে বাংলাদেশের। বৈঠকগুলোর পর শুল্কহার আরও কমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রসঙ্গত, ২ এপ্রিল ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের ওপর অতিরিক্ত ৩৭ শতাংশ পালটা শুল্ক আরোপ করে। দুই শতাংশ কমিয়ে বাংলাদেশের জন্য এখন ৩৫ শতাংশ করায় সব মিলিয়ে ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর মোট শুল্ক দাঁড়াবে ৫০ শতাংশ। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক ছিল।

সংশ্লিষ্টদের মতে, ১ আগস্ট আসতে বাকি মাত্র ২২ দিন। এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের সঙ্গে ভালোভাবে দরকষাকষি করতে পারলে শুল্কহার কমতে পারে। অন্যথায় ঘোষিত হারই কার্যকর হবে। সেক্ষেত্রে বিপদের শেষ থাকবে না।

প্রধান উপদেষ্টাকে শুল্ক আরোপের কথা জানিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন চিঠি দেওয়ার পর মঙ্গলবার সরকারের নীতি-নির্ধারণী মহলসহ সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে বিষয়টি নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা শুরু হয়। এদিন সচিবালয়ে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি তুলনামূলক কম। এরপরও ৩৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের ‘ন্যায্যতা’ থাকে না। বিষয়টির সুরাহা করতে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। তাদের সঙ্গে আরেকটি মিটিং আছে। এখন বৈঠকটি মোটামুটি পজিটিভ হবে। ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছেন। এখন ওয়ান টু ওয়ান নেগোসিয়েশন হবে।’

এদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চিঠি দিয়ে ঘোষণা করেছেন, ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রতিপক্ষের সঙ্গে এ নিয়ে বাংলাদেশের একটি দল বেশ কয়েক দফা আলোচনা করেছে। ৯ জুলাই আরেক দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। আলোচনায় বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেবেন শেখ বশিরউদ্দীন। ঢাকা ওয়াশিংটন ডিসির সঙ্গে একটি শুল্কচুক্তির জন্য উন্মুখ। আমরা আশা করি, উভয় দেশেরই জয় হবে।’

এদিকে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সামনে এক মাস রেখে আজ (মঙ্গলবার) যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুল্ক আরোপ সংক্রান্ত ডকুমেন্ট হ্যান্ডওভার করেছে। নেগোসিয়েশনের ডেট দেওয়া হয়েছে। যেটা তাদের পক্ষ থেকেই দেওয়া হয়েছে। এর মানে, নেগোসিয়েশনের দরজা খোলা রয়েছে। আমরা আলোচনায় যুক্ত হচ্ছি। বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখানে আছেন। সেখানে অংশ নিতে আমি মঙ্গলবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওয়ানা হব। আশা করি, কিছু একটা ফল আমরা পাব আলোচনার মাধ্যমে।’ নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে শুল্ক কমাতে না পারলে আমদানি-রপ্তানির ওপর চাপ পড়বে কি না-প্রশ্নের উত্তরে সচিব বলেন, ‘প্রেশার হবে, সেটা সবাই বুঝতে পারছি। সেটা যাতে না হয়, সেজন্য আমরা যাচ্ছি আলোচনা করতে। আশা করছি ভালো কিছুই পাব।’

জানা যায়, সোমবার থেকে ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানদের চিঠি দিয়ে নতুন হারে শুল্ক আরোপের কথা জানাতে শুরু করেছেন। এখন পর্যন্ত জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, বাংলাদেশ, সার্বিয়া, থাইল্যান্ড ও তিউনিসিয়ার মতো রপ্তানিকারক দেশসহ ১৪টি দেশকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ৭ জুলাই লেখা চিঠিতে ট্রাম্প বলেন, ‘দুঃখজনকভাবে, আমাদের সম্পর্ক সমকক্ষ হওয়া থেকে অনেক দূরে। ২০২৫ সালের ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো বাংলাদেশের যে কোনো পণ্যের ওপর আমরা মাত্র ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করব।’

তিনি বলেন, ‘এই শুল্ক সব খাত ভিত্তিক শুল্কের অতিরিক্ত হিসাবে প্রযোজ্য হবে। উচ্চশুল্ক এড়াতে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে পণ্য পাঠানো হলে তার ওপরও সেই উচ্চশুল্ক আরোপ হবে। দয়া করে এটা অনুধাবন করুন, আপনার দেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য বৈষম্য দূর করতে যা প্রয়োজন, তার থেকে ওই ৩৫ শতাংশ সংখ্যাটি অনেক কম।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘আপনি যদি কোনোভাবে শুল্ক বৃদ্ধি করেন, তাহলে আপনি যতটা বাড়াবেন, তা আমাদের আরোপিত ৩৫ শতাংশের ওপর যোগ হবে।’

ট্রাম্প বলেছেন, ১ আগস্টের সময়সীমা একেবারে চূড়ান্ত নয়। যেসব দেশ আরও ছাড় দিতে রাজি, তাদের প্রতি সদয় হবেন জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘পরিস্থিতি বুঝে কিছুটা সমন্বয় করা যেতে পারে... আমরা অবিচার করব না।’ তবে ট্রাম্প সতর্ক করে বলেছেন, ‘বাণিজ্যিক অংশীদাররা কোনো প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করলে জবাবে সমপরিমাণ শুল্ক আরোপ করা হবে।’

এর আগে বাংলাদেশের পক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ট্রাম্পকে চিঠি দিয়ে ৩ মাসের জন্য ২ এপ্রিলের ঘোষণা করা শুল্ক স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ওই সময়ের মধ্যে মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক কমিয়ে ভারসাম্য আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তাদের শীর্ষ পণ্যের ওপর শুল্ক ৫০ শতাংশ কমানোর কথা বলেছিল বাংলাদেশ।

এদিকে বাংলাদেশ আশা করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হার ২০ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে। সরকারের যুক্তি ছিল, ভিয়েতনামের মতো প্রতিযোগী দেশগুলো ২০ শতাংশ শুল্ক সুবিধা পেলে বাংলাদেশি পণ্যে শুল্ক আরও কম হওয়া উচিত। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল বর্তমানে ওয়াশিংটনে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে সেখানে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানও আছেন। তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে শেষ মুহূর্তে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব না হলে ৩৫ শতাংশ শুল্কই বহাল থাকবে, যা দেশের রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য একটি বড় আঘাত হবে।

জানা গেছে, দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৪ ভাগই আসে তৈরি পোশাক থেকে। আর একক দেশ হিসাবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। গত বছর মোট রপ্তানির ১৮ শতাংশ ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে মোট রপ্তানি পণ্যের ৮৭ শতাংশ হচ্ছে তৈরি পোশাক। গত বছর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ৭৩৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে।

মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮৩৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই হিসাবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য-ঘাটতির পরিমাণ ৬১৫ কোটি ডলার।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক কমানোর শর্ত হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যেসব পণ্য বাংলাদেশ আমদানি করে সেসব পণ্যে পর্যায়ক্রমে শুল্ক, ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি হ্রাস চেয়েছে। এরই অংশ হিসাবে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। বিশেষ করে সরকারি খাতে ফুড ড্রিংক, বোয়িং বিমান ও মিলিটারি ইক্যুইপমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে গুরুত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত গম, সয়াবিন এয়ারক্রাফট ও অন্যান্য মেশিনারির ওপর ডিউটি খুব কম। তুলা আমদানিকে আরও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তুলা আমদানির ওপর ২ শতাংশ এআইটি আছে। সেটি প্রত্যাহার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি যাতে বেশি হয় সেজন্য কিছু সুবিধা দেওয়ার চিন্তা করছে সরকার।

এদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে আর যেসব দেশ শুল্কের খড়গে পড়েছে তার মধ্যে রয়েছে-লাওস, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, সার্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, বসনিয়া, হার্জেগোভিনা, মালয়েশিয়া, তিউনিসিয়া, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ শুল্কের মুখে পড়েছে মিয়ানমার ও লাওস। তবে ট্রাম্প আগেই ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ আরোপের কথা বলেছেন।

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত ও চীন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি সুবিধা পাবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পাকিস্তানও পণ্য রপ্তানির সুযোগ পাচ্ছে। ফলে এটা সুস্পষ্ট যে, তিনটি দেশের তুলনায় তৈরি পোশাকে বাংলাদেশকে বেশি প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। 
Print Close  
Print Close  
News Source
            Top
            Top
 
Home / About Us / Benifits /Invite a Friend / Policy
Copyright © Hawker 2009-2010, Allright Reserved