[ অনলাইন ] 2025-07-09
 
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের অভিমত
বড় ধাক্কা খাবে রপ্তানি খাত
 
যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক শুল্ক বাংলাদেশের রপ্তানি শিল্পের জন্য অশনিসংকেত। বর্ধিত এ শুল্কারোপ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে তৈরি পোশাক শিল্পকে। এছাড়া কৃষিপণ্যসহ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি করা সব পণ্যই ক্ষতির মুখে পড়বে। এর ফলে পুরো অর্থনীতিজুড়ে বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। যুগান্তরের কাছে এমন মন্তব্য করেন অর্থনীতি ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা।

তারা বলেন, শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ককে সরকার হালকাভাবে নিয়েছে। আরেকটু সিরিয়াসলি নিলে হয়তো বাংলাদেশ আরও ভালো অবস্থানে থাকত। তবে এখনো সময় চলে যায়নি। ট্রাম্প প্রশাসন আলোচনার দরজা খোলা রেখেছে। যত দ্রুত সম্ভব আলোচনা শুরু করা দরকার। দ্বিপাক্ষিক নেগোশিয়েশনের দুর্বলতা কাটাতে প্রয়োজনে লবিস্ট নিয়োগ করা যেতে পারে। তবে আলোচনার পরও যদি শুল্ক না কমে তাহলে রপ্তানি শিল্পের জন্য তা ভালো হবে না। কারণ প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ এবং ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। শুল্কের পার্থক্য ২-৩ শতাংশ থাকলে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব ছিল। কিন্তু এর বেশি হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। রপ্তানিমুখী অনেক শিল্প বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান যুগান্তরকে বলেন, এ শুল্কের প্রভাব তৈরি পোশাক শিল্পে ভয়াবহ সংকট দেখা দিতে পারে। আনুমানিক ৮ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার সরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটি ঘটলে অনেক গার্মেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ অনেক গার্মেন্ট শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর নির্ভর করে ব্যবসা করছে। তাদের পক্ষে রাতারাতি অন্য বিদেশি ক্রেতার কাজ শুরু করা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, আমেরিকার বাজার সংকুচিত হলে স্বভাবতই যেসব গার্মেন্ট ওই বাজারে ব্যবসা করত তারা কানাডা বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে নজর দেবে। তখন নিজেদের মধ্যে টিকে থাকতে অসম প্রতিযোগিতা শুরু হবে। তিনি বলেন, এর আগে সরকারের তরফ থেকে ভালো ফল পাওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাইনি। সরকারের উচিত, এখনই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরু করা, প্রয়োজনে লবিস্টও নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। তিনি জানান, এই শুল্কারোপের ফলে শিল্পের ওপর প্রভাব কী হবে তা তুলে ধরতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করবেন বিজিএমইএ নেতারা।

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেন, এ শুল্কের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত বড় ধাক্কা খাবে। এ ধাক্কা সামাল দেয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ইতোমধ্যে বিদেশি ব্র্যান্ড ও ক্রেতারা বলতে শুরু করেছেন, বাংলাদেশ সঠিকভাবে আলোচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে তাদের আস্থা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। তিনি আরও বলেন, আলোচনায় বাংলাদেশ সঠিক প্রচেষ্টা ও পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারেনি। আলাপ-আলোচনা শুধু ইউএসটিআরের (যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তর) সঙ্গে হয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি ওয়াশিংটনকেন্দ্রিক আলাপ-আলোচনাও হওয়া উচিত ছিল। সেখানে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ দেওয়া দরকার। দ্বিপাক্ষিক নেগোশিয়েশনের অনেক ভাষা বা পদ্ধতি বাংলাদেশের আমলারা বা ব্যবসায়ীদের পক্ষে বোঝানো সম্ভব নয়। অথচ এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে ইতোমধ্যেই ভারত ও ভিয়েতনাম সেখানে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ দিয়েছে।

আনোয়ার পারভেজ বলেন, অপ্রকাশযোগ্য শর্ত শুধু সরকারের নীতি-নির্ধারণ বা আমলাদের মধ্যে লুকিয়ে রাখলে হবে না। এ ধরনের শর্ত বাস্তবায়নযোগ্য কিনা, বাস্তবায়নযোগ্য হলে তা দেশ ও অর্থনীতির ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে, সেগুলো বিচার-বিশ্লেষণের জন্য আলাপ-আলোচনা করা উচিত ছিল।

বাংলাদেশ নিটপণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ট্রাম্পের এ শুল্ক আরোপ বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের ওপর কী প্রভাব ফেলব তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এটা নির্ভর করবে চীন ও ভারতের ওপর কী হারে শুল্কারোপ করে, তার ওপর। যদি এই দুই দেশের ওপর বাংলাদেশের চাইতে বাড়তি হারে শুল্কারোপ করে তাহলে রপ্তানি খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নেগোশিয়েশনের পূর্বে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের তরফ থেকে আলাপ-আলোচনা করা হয়নি। যদি আলোচনা করা হতো তাহলে ব্যবসায়ীরা হয়তো অর্থনীতি ও রপ্তানি খাতের প্রকৃত অবস্থা-সক্ষমতা বোঝাতে পারতেন।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করার পর সর্বপ্রথম বাংলাদেশ এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়, যা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এরপর ৩ মাস আলাপ-আলোচনার পর মাত্র ২ শতাংশ শুল্ক কমাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু যে হারে শুল্কারোপ করার কথা বলা হচ্ছে তাতে বাংলাদেশের রপ্তানিকে বাধাগ্রস্ত করবে, এমনকি বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তৈরি পোশাকের জন্য এটা অশনিসংকেত। কারণ প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম ইতোমধ্যে নেগোশিয়েট করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় অপ্রকাশযোগ্য কিছু শর্ত দেওয়ায় হয়তো অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে পারেনি। অশুল্ক বাধা ছাড়া অন্য কোনো শর্ত ছিল কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শুল্ক ছাড় ছাড়াও অন্য কোনো শর্ত আছে কিনা সেটাও নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় নিতে হবে। সামনে ৩ সপ্তাহ সময় আছে। আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক কাঠামো ভিয়েতনামের পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারলে তা মন্দের ভালো হবে। প্রতিযোগিতার পরিবেশ অপরিবর্তিত থাকবে।

ড. মোস্তাফিজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপকে শুধু অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে নয়, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। এছাড়া থাকতে পারে ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক ইস্যু। কিন্তু শর্ত প্রকাশ না করায় সেটা স্পষ্ট নয়।

আরেক গবেষণা সংস্থা র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. এমএ রাজ্জাক বলেন, শুল্কারোপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তার ব্যবসায়িক অংশীদার দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে চাচ্ছে। ইতোমধ্যেই ভিয়েতনাম চুক্তি করতে সক্ষম হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তিসংক্রান্ত নেগোশিয়েশন ক্ষমতা গড়ে উঠেনি। যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক চুক্তির যেসব শর্ত দিয়েছে তা সরকার জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি। ফলে ব্যবসায়ী বা অর্থনীতিবিদরা এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি। তিনি আরও বলেন, প্রথম পর্যায়ে শুল্কারোপের পর তা স্থগিত করায় সরকার ৩ মাসের বেশি সময় পেয়েছে। এ সময় বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে বাজেটে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাও উপযুক্ত নয়। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় প্রস্তুতির ঘাটতি আছে বলে মনে হয়। 
Print Close  
Print Close  
News Source
            Top
            Top
 
Home / About Us / Benifits /Invite a Friend / Policy
Copyright © Hawker 2009-2010, Allright Reserved