[ অনলাইন ] 13/07/2025 |
|
|
|
বিদেশ থেকে অপহরণ মুক্তিপণ বাংলাদেশে |
 |
|
লিবিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রায়ই শিকার হচ্ছেন অপহরণের। আর তাদের মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে বাংলাদেশে। প্রায়ই ঘটছে এ ধরনের ঘটনা। তবে মূল হোতারা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অপহরণের পর মুক্তি পাওয়া ভিকটিম এবং তাদের স্বজনদের মতে, অত্যন্ত শক্তিশালী ও সুসংগঠিত এই চক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতে, ‘কাট আউট’ পদ্ধতিতে কাজ করায় ভাঙা যাচ্ছে না সিন্ডিকেট।
কেন লিবিয়াতেই বেশি অপহরণ : খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিদেশে অপহরণের পর বাংলাদেশে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে লিবিয়াতে। মূলত লিবিয়া হয়ে ইতালিসহ ইউরোপে যাওয়ার প্রলোভনে পড়ে অপহরণের এসব ঘটনা ঘটছে। কখনো কখনো দেশ-বিদেশে চক্রের কিছু সদস্য ধরা পড়লেও থেমে নেই তাদের কার্যক্রম
কেন লিবিয়াতেই সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি অপহরণের শিকার হচ্ছেন এমন প্রশ্নে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য দিয়েছেন ভিকটিমরা। কীভাবে তাদের অপহরণ করা হচ্ছে, কীভাবে আদায় করা হচ্ছে মুক্তিপণ- সেসব বিষয়েও তারা জানিয়েছেন বিস্তারিত।
২০২২ সালের অক্টোবরে অবৈধভাবে লিবিয়াতে যান নোয়াখালীর আলমগীর হোসেন। কাজ করতেন জমাজৈতন এলাকার একটি ওয়ার্কশপে। গত ৮ জানুয়ারি তার কর্মস্থল থেকে তিনিসহ সিরাজউদ্দিন নামের একজন বাংলাদেশিকে অপহরণ করা হয়। কয়েক দফায় ৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করা হয় আলমগীরের পরিবারে কাছ থেকে। এ ঘটনায় তার পরিবার রাজধানীর আদাবর থানায় মামলা করে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এই মামলার তদন্ত করে। গ্রেফতার করা হয় দুজনকে।
পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই উত্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. এনায়েত হোসেন মান্নান জানান, এই অপহরণ ও মুক্তিপণের ঘটনায় বাগেরহাট থেকে মিন্টু ফরাজি ও রাজশাহী থেকে রাসেল নামের দুজনকে গ্রেফতার করে। এক পর্যায়ে লিবিয়াতে অপহরণকারীরা আলমগীর ও সিরাজউদ্দিনকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে পিবিআই দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় আলমগীরকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। কাগজপত্র-সংক্রান্ত কিছু জটিলতার কারণে সিরাজউদ্দিনকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলে জানান তিনি।
অবৈধ বিদেশযাত্রা, অপহরণ ও অকথ্য নির্যাতন : দেশে ফিরে আসা আলমগীর এই প্রতিবেদককে জানান, দালালের মাধ্যমে কাজের উদ্দেশ্যে দুবাই হয়ে তিনি ২০২২ সালের অক্টোবরে লিবিয়াতে পৌঁছান। লিবিয়াতে যাওয়ার পর তিনি জানতে পারেন বাংলাদেশি ও পাকিস্তানিদের অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। জানতে পেরে তিনি ভীত হয়ে পড়েন। সবসময় আতঙ্কে থাকতেন। কিন্তু দেশে ফিরে আসারও কোনো উপায় ছিল না তার। অবৈধভাবে লিবিয়াতে যাওয়ায় দেশে ফিরতে হলে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হবে। আবার ৪ লাখ টাকা ঋণ করে লিবিয়াতে যাওয়ায় সেই ঋণ পরিশোধের বোঝাও ছিল মাথায়। কিন্তু সেই আশঙ্কার মাঝেই চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি তার জীবনে নেমে আসে সেই অন্ধকার দিনটি। ওয়ার্কশপে কাজ করা অবস্থায় মিলিশিয়া (লিবিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) পরিচয়ে সাদা পোশাকে কয়েকজন এসে তাকেসহ দুজনকে ধরে নিয়ে যায়। যাওয়ার আগে তার কাছে থাকা ৬ হাজার লেবাননি দিনার নিয়ে যায়। দুজনকে চোখ বেঁধে একটি গাড়িতে করে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় একটি বাড়িতে। সেখান থেকে তাদের দুজনকে বিক্রি করে দেওয়া হয় বাংলাদেশিদের কাছে। ওই বাংলাদেশিরা তাদের বিশাল কমলা ও মাল্টা বাগানের মধ্যে একটি বাড়িতে নিয়ে বন্দি করে। সেখানে তাদের ওপর চালানো হয় অমানসিক নির্যাতন। সেই সঙ্গে চাপ দিতে থাকে পরিবারের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা নিয়ে আসার জন্য।
বন্দিদশায় সারা দিনে একবেলা দেওয়া হতো দুটি বিস্কুট আর সামান্য পানি। আলমগীর জানান, অপহরণকারীরা সবাই ছিল বাংলাদেশি। তারা শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে নির্মম নির্যাতন করত। ঝুলিয়ে পেটাতো। নানান কৌশলে চালাত নির্যাতন। শীতের মধ্যে শরীরের সব কাপড় খুলে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখত। এক পর্যায়ে তিনি বাধ্য হন পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। পরে তার ভাইয়ের মাধ্যমে অপহরণকারীদের বাংলাদেশের একটি ব্যাংকের মাধ্যমে ৪ লাখ টাকা দেওয়া হয়। তিনি আরও জানান, বন্দি অবস্থায় তিনি তার মতো আরও ৮-১০ জন বাংলাদেশিকে সেখানে দেখেছেন। তাদের ওপরও একই ধরনের শারীরিক নির্যাতন করা হচ্ছিল।
আলমগীর সেখানে এমন অনেক বন্দি দেখেছেন, যাদের ১২ থেকে ১৭ মাস ধরে মুক্তিপণের জন্য বন্দি করে নির্যাতন করা হচ্ছে। ওই বন্দিদের মুক্তির উদ্যোগ নিতে তিনি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বিনীত অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, লিবিয়াতে অবৈধভাবে অবস্থানকারী বাংলাদেশ ও পাকিস্তানিরা অপহরণকারীদের প্রধান টার্গেট। এসব কাজে এক শ্রেণির প্রবাসী বংলাদেশি সরাসরি জড়িত। তাদের সঙ্গে মিলিশিয়াসহ আরও নানা স্তরের অপরাধীদের যোগসাজশ আছে। এরা খুবই শক্তিশালী। বাংলাদেশেও এই চক্রের সদস্য রয়েছে।
অপহরণের শিকাররাই যখন অপহরণকারী : আলমগীর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, কীভাবে একই দেশের মানুষ হয়েও এক শ্রেণির প্রবাসী বাংলাদেশি অন্য বাংলাদেশিদের ওপর অর্থের জন্য এমন নির্মম নির্যাতন করতে পারে! অপহরণকারী বাংলাদেশিরা খুব ভালো করেই জানে, লিবিয়াতে যারা কাজের জন্য আসে তারা সবাই নিম্নবিত্ত পরিবারে সন্তান। ঋণ করে তারা বিদেশে গেছেন। তারপরও অপহরণকারীদের মনে বিন্দুমাত্র মায়া-দয়া নেই! তিনি বলেন, বন্দি অবস্থায় তিনি জানতে পারেন, অপহরণকারীদের একাংশ নিজেরাই একসময় অপহরণের শিকার হয়েছিল। মুক্তি পেয়ে নিজেরাই পরে জড়িয়ে পড়েন অপহরণের কাজে।
সিআইডিতে থাকা অতিরিক্ত এসপি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তাও একই কথা বলেন। মানব পাচার-সংক্রান্ত সেলের এই কর্মকর্তা সময়ের আলোকে বলেন, বিদেশে মানব পাচারের শিকার কিছু বাংলাদেশি প্রবাসী নিজেরাই এক পর্যায়ে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
এদিকে আলমগীরে ভাই আবদুল মালেক সময়ের আলোকে বলেন, অপহরণকারীদের ৪ লাখ টাকা দেওয়ার পর তিনি ও তার পরিবার শক্ত অবস্থানে চলে যায়। তিনি সরাসরি বলেন, ‘আমরা ৫ ভাই। এক ভাই মরে গেলেও কিছু হবে না।’ মূলত অপহরণকারীদের ঘাবড়ে দিতেই তিনি এই কৌশল অবলম্বন করেন। একই সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করেন পিবিআইর সঙ্গে। তাদের পরামর্শেই আদাবর থানায় মামলা করেন। পিবিআইর আন্তরিক সহযোগিতায় ভাইকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন বলে জানান তিনি। আবদুল মালেক আরও বলেন, এ রকম অনেক অপহরণের ঘটনা ঘটে চলেছে। কিন্তু অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়াতে কেউ সাহস করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাহায্য চায় না। তিনি বলেন, চক্রটি বেশ বড় এবং শক্তিশালী বলেই মনে হয়েছে তার কাছে। চক্রটির সদস্যরা খুবই বেপরোয়া ও হিংস্র। অপহরণের পর কয়েক দফা বিক্রি করা হয় বন্দিদের। যত হাত ঘুরবে মুক্তিপণের টাকা তত বৃদ্ধি পেতে থাকে।
কাট আউট পদ্ধতির চক্র ধরা ছোঁয়ার বাইরে : গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, মানব পাচার কিংবা অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়কারী চক্রটি অনেকটাই ‘কাট আউট’ পদ্ধতিতে কাজ করে থাকে। যার ফলে বাংলাদেশে তাদের হয়ে কাজ করা তৃণমূল পর্যায়ের চক্রের সদস্যকে গ্রেফতার করা সম্ভব হলেও কখনোই শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হয় না। কারণ এই চক্রের শীর্ষে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের চক্রের সদস্যদের কখনোই যোগাযোগ হয় না। চক্রের একটি স্তর তার পরবর্তী ধাপের সঙ্গে পরিচিত থাকলেও তার পরবর্তী ধাপে থাকা ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু জানে না চক্রের তৃণমূলের ব্যক্তিটি।
সূত্রটি জানায়, এসব মামলার তদন্তের এক পর্যায়ে তৃণমূল পর্যায়ের দালালদের গ্রেফতার করা সম্ভব হলেও ওপরের পর্যায়ে থাকা এজেন্টদের আর আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না। কারণ তারা ওইসব এজেন্ট তাদের নয় বলে দাবি করা হয়। এ ছাড়া উপযুক্ত প্রমাণাদিও পাওয়া যায় না অনেক ক্ষেত্রে। ফলে মানব পাচারে জড়িত নেপথ্যের লোকজনদের সাজা হওয়ার পরিমাণ তুলনামূলক অনেক কম।
কেন ভাঙা যাচ্ছে না সিন্ডিকেট : অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়কারী চক্রের সিন্ডিকেটটি কেন ভেঙে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না-এমন প্রশ্নের জবাবে পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) অতিরিক্ত ডিআইজি এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, অবশ্যই এটি একটি চক্র। এদের এক পক্ষ আরেক পক্ষকে চিনে না। তাই দেশে থাকা তাদের একটি পক্ষকে গ্রেফতার কর সম্ভব হলেও পুরো চক্রটি ভেঙে ফেলা যাচ্ছে না। তবে তদন্ত অব্যাহত আছে বলে জানান তিনি।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে লিবিয়ার মিসরাতা শহরে অভিযান চালিয়ে ২৩ অপহৃত বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে দেশটির সিআইডি পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় দুজনকে। গত বছরের ২৭ জুন লিবিয়ায় মানব পাচার ও মুক্তিপণ আদায়কারী চক্রের দুজনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। একই বছরের ৮ জুন লিবিয়া প্রবাসী চার বাংলাদেশি যুবককে অপহরণের পর পরিবারের কাছে ১০ লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে তাদের পরিবার। গত বছরের ১৭ জানুয়ারি লিবিয়া প্রবাসী মোরশেদ আলমকে অপহরণের পর তার স্ত্রী জাহানারা বেগমের কাছে অর্থ দাবি করা হয়। বিকাশের মাধ্যমে কয়েক দফায় তিনি দেড় লাখ টাকা পরিশোধ করেন। তিনি জানান, অপহরণকারীরা তার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তাদের বাংলাদেশি বলেই মনে হয়েছে তার। |
News Source
|
|
|
|
|
|
|
|
Today's Other News
|
Related Stories |
|
|
 |
|