বাস্তবসম্মত ছবি, লাইভ ডিপফেক ভিডিও এবং সাবলীল ভাষায় কথা বলতে পারে এমন কণ্ঠ তৈরি করার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সেবাগুলো প্রতারণাকে সহজ করেছে। প্রিয়জনদের কণ্ঠ নকল করে অথবা বিখ্যাত ব্যক্তির ডিপফেক ভিডিও তৈরির মাধ্যমে প্রতিনিয়ত কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকচক্র। এআই যুগের ডিজিটাল প্রতারণা নিয়ে লিখেছেন এস এম তাহমিদ
বিশ্বাস মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এটিকে পুঁজি করে প্রতারকরা ফাঁদ পাতে, হাতিয়ে নেয় অর্থ-সম্পদ অথবা করে অন্য কোনো ধরনের ক্ষতি। যেমন—চরিত্র হননের মাধ্যমে সামাজিকভাবে হেয় করা। বিশ্বাসের পাশাপাশি হুজুগ হচ্ছে প্রতারকদের আরেকটি হাতিয়ার।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে হুজুগ ও বিশ্বাস কাজে লাগিয়ে বড়সড় প্রতারণার ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটেছে, এখন কাজটিকে আরো সহজ করেছে এআই। অনেকের ধারণা, প্রতারকদের ফাঁদে তারা কখনো ফাঁসবে না। গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা। সচেতন, বুদ্ধিমান ব্যক্তিদেরও ভুল হয়, আবেগের বশে তারাও প্রতারকদের বিশ্বাস করে ফেলে।
ভুক্তভোগীর মনে প্রতারকরা বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করার জন্য বেশ কয়েকটি উপায় ব্যবহার করে থাকে। এর মধ্যে আছে পরিচয়ের শুরুতে কথা দিয়ে কথা রাখার মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি অথবা ভুক্তভোগীকে শুরুতে কিছু অর্থ দিয়ে বিশ্বাস আদায় করা। এগুলো এতটাই কার্যকর যে শত বছরেও এ উপায়গুলো বদলায়নি। প্রতারকচক্রের অন্য সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ‘আপনি একা নন’ এমন বোধ তৈরি করেও ভুক্তভোগীদের মনে বিশ্বাস তৈরি করে তারা।
কিছু ক্ষেত্রে নিজেকে কর্তৃপক্ষের অংশ হিসেবে পরিচয় দিয়েও ঠকবাজি করে থাকে এসব চক্র। প্রেমের ফাঁদে ফেলে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মতো অপরাধও অহরহ ঘটছে।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, ভুক্তভোগীদের আবেগের সুযোগ নিয়ে বিশ্বাস তৈরি করা হয়। সরল মনের মানুষেরা এসব ফাঁদে সহজেই পড়ে। যারা প্রতারকদের সন্দেহের চোখে দেখেও ‘দেখি কী হয়’ চিন্তা থেকে এক পা হলেও এগিয়ে যায়, দেখা যায় তারাই আরো গভীরভাবে প্রতারকদের বিশ্বাস করে বসে।
ফলাফল, তাদের ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণও বেশি হয়ে থাকে।
এআই টুলসের আগমন
জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন সংস্থার উচ্চ পদের কর্তকর্তা অথবা প্রিয়জনদের প্রতি আস্থা থাকে প্রায় সবার। এ ধরনের পরিচয় ব্যবহার করে ভুক্তভোগীদের বিশ্বাস অর্জন করা তাই প্রতারকচক্রের জন্য বেশ সহজ। মাত্র দুই বছর আগেও এ কাজটি ছিল একপ্রকার অসম্ভব। এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে বাস্তবসম্মত ছবি, ভিডিও এবং কণ্ঠ তৈরি করা যায়। খুব বেশি অর্থেরও প্রয়োজন হয় না। কিছু ক্ষেত্রে ফ্রি টুলস ব্যবহার করেই বাস্তবসম্মত ভুয়া ভিডিও ও অডিও তৈরি করে, ভুয়া প্রোফাইল তৈরি করা যায়। ওয়েবক্যামে ধারণ করা লাইভ ভিডিও এবং অডিও যে ব্যক্তিকে নকল করা হবে হুবহু তার মতো করে বদলে ফেলা যায় এআইয়ের মাধ্যমে। সে জন্য প্রয়োজন শুধু ওই ব্যক্তির ছবি, ভিডিও এবং অডিও রেকর্ডিং। এআইয়ের মধ্যে সেসব তথ্য আপলোড করে মডেল ট্রেইন করে নেওয়া সহজ, এ জন্য প্রযুক্তির বিষয়ে তেমন জানাশোনার প্রয়োজন নেই। শক্তিশালী কম্পিউটারেরও প্রয়োজন নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে প্রতিটি ব্যক্তির ছবি ও ভিডিও অনলাইনে পাওয়া কঠিন নয়।
ছবি, অডিও, ভিডিও এবং লাইভ ভিডিও—সব কিছু এখন নিখুঁতভাবে এআই দিয়ে তৈরি করা যায়। গত বছরের শেষভাগেও এআইয়ের তৈরি ভিডিও দেখে সেটি বোঝার উপায় ছিল। এখন খালি চোখে দেখে বোঝা প্রায় একপ্রকার অসম্ভব। ডিপফেক ছাড়াও যেকোনো দৃশ্যের অত্যন্ত বাস্তব ভিডিও তৈরি করা এখন এক ক্লিকে সম্ভব।
প্রতারণার ধরন
এআই কাজে লাগিয়ে বেশ কয়েক প্রকারের প্রতারণা প্রচলিত। এর মধ্যে আছে—
► ডিপফেক কল : ভুক্তভোগীদের লাইভ ডিপফেক অডিও বা ভিডিও কল করে প্রতারকরা। যে ব্যক্তিকে নকল করা হয়েছে, তার বিষয়ে তথ্য দিয়ে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করে। এরপর হাতিয়ে নেয় অর্থ ও গোপন তথ্য। এই প্রতারণার মাধ্যমে গত বছরের মে মাসে যুক্তরাজ্যের ফিন্যান্স প্রতিষ্ঠান অরুপের হংকং শাখা থেকে প্রতারকরা হাতিয়ে নেয় দুই কোটি ৫০ লাখ ডলার। সম্প্রতি আমাদের দেশেও ঘটেছে এমন ঘটনা। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কণ্ঠ নকল করে এক প্রতারকচক্র মাত্র ১১ মাসে ২৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ ছাড়াও ভুক্তভোগীর কণ্ঠ ও চেহারা নকল করে পরিবারের কাছে মিথ্যা ছড়ানো, ছলনা করে অর্থ আদায়ের মতো ঘটনাও ঘটছে আমাদের দেশে।
► প্রেমের ফাঁদ : আকর্ষণীয় চেহারার ভুয়া ছবি তৈরি করে ডেটিং অ্যাপগুলোতে প্রোফাইল তৈরি করে প্রতারকচক্র। একই চেহারা ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রোফাইল তৈরি করে তারা। ফলে চট করে বোঝাও যায় না যে বাস্তবে এ ব্যক্তিটির অস্তিত্ব নেই। এভাবে কয়েকটি প্রোফাইল তৈরি করে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথন চালায় প্রতারকরা, ডিপফেকের মাধ্যমে ভিডিও কলে কথাও বলে। এভাবে বিশ্বাস তৈরি করে ভুক্তভোগীদের গোপন তথ্য জেনে নেয় তারা। প্রেমের ছলনায় অর্থ আদায় করার চেষ্টা করে। এরপর গোপন তথ্য কাজে লাগিয়ে শুরু হয় ব্ল্যাকমেইল করা। ভিডিও কলের রেকর্ডিং ও কথোপকথনে স্ক্রিনশটও এ কাজে ব্যবহৃত হয়। বিপুল পরিমাণ অর্থ না দিলে এসব তথ্য ও ভিডিও ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেয় প্রতারকরা। কিছু ক্ষেত্রে প্রতারকরা সরাসরি দেখা করতে চায়। এরপর ভুক্তভোগীর সর্বস্ব লুটে নেওয়ার পাশাপাশি অপহরণ ও খুনের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।
► সোশ্যাল মিডিয়া বট : ফেসবুক, এক্স তথা টুইটার বা ইনস্টাগ্রামে ভুয়া প্রোফাইল তৈরি করে হাজারো ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যায় প্রতারকরা। অর্থ জালিয়াতি এখানে লক্ষ্য নয়, বরং ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া। রাজনৈতিক স্বার্থে গুজব সংবাদ এবং ভিডিও ছড়ানো বা প্রতিশোধ হিসেবে চরিত্র হননের লক্ষ্যে ডিপফেক ভাইরাল করার মতো কাজগুলো বট প্রোফাইল করে থাকে। এখানে অর্থের উৎস যারা বট ভাড়া করে তারা, ভুক্তভোগীরা নয়।
বাঁচার উপায়
যাচাই না করে কিছু বিশ্বাস করা উচিত নয়। মনে রাখতে হবে, ইন্টারনেটের কোনো সম্পাদক বা সেন্সর নেই, যে কেউ যা ইচ্ছা পোস্ট করতে পারে। পরিচয় যাচাই না করে কারো কথা বিশ্বাস করা উচিত নয়। অডিও-ভিডিও কল এলে সেটি কোন নম্বর বা আইডি থেকে করা হয়েছে, সেটা অবশ্যই খেয়াল করতে হবে। পরিচিত বা প্রিয়জনের পরিচয়ে কেউ টাকা চাইলে, অন্য আরেকটি উপায়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচাই করতে হবে, কলটি এলেই সে করেছিল কি না। ইন্টারনেটে কারো সঙ্গে পরিচয় হলে অবশ্যই কোনো নিরাপদ স্থানে দেখা করে যাচাই করা উচিত ব্যক্তিটি বাস্তব কি না। অবিশ্বাস্য কোনো সংবাদ চোখে পড়লে একাধিক গণমাধ্যমে সেটি পোস্ট করা হয়েছে কি না সেটি দেখতে হবে।