Hawkerbd.com     SINCE
 
 
 
 
ধোঁয়াশায় পাঁচ ইসলামী ব্যাংক [ অনলাইন ] 26/06/2025
ধোঁয়াশায় পাঁচ ইসলামী ব্যাংক
শফিকুল ইসলাম :

# পাঁচ ব্যাংকের আমানত ১৪৭৩৬৮ ও ঋণ ১৯০৪৮৪ কোটি টাকা

# ঋণের ৭৭% অর্থাৎ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কো‌টি টাকা খেলা‌পি

# ব্যাংকগুলোর অনুমোদিত মূলধন ১২০০০ কোটি টাকা ও পরিশোধিত মূলধন ৫৮১৯ কোটি টাকা

# অনিশ্চয়তায় ৯২ লাখ গ্রাহক ও ১৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী।

# একীভূতকরণে এক্সিমের আপত্তি


বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সহযোগিতায় বিশেষ কিছু শিল্পগোষ্ঠীর অযাচিত হস্তক্ষেপ, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দেশের পাঁচটি শরিয়াভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংক চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এই ব্যাংকগুলোর ঋণের বড় একটি অংশ এখন খেলাপি হয়ে গেছে। ফলে লোকসানে থাকা ব্যাংকগুলো অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুর্বল এই ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে নতুনভাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে।

এই সিদ্ধান্তে যেমন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে, তেমনি তৈরি হয়েছে নানা শঙ্কা ও বিতর্ক। ফলে গ্রাহক ও ব্যাংক কর্মকর্তারা রয়েছেন গভীর অনিশ্চয়তায়।

যে পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো— ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক।

এই পাঁচটির মধ্যে চারটি ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। একমাত্র এক্সিম ব্যাংক ছিল নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদারের অধীনে।

২০২৩ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে বড় পরিবর্তন আনা হয়। এক্সিম ব্যাংক ছাড়া বাকি চারটিতে স্বতন্ত্র পরিচালকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ও বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এই পাঁচ ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা এবং বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকাই খেলাপি, যা মোট ঋণের ৭৭ শতাংশ।

এই পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত অনুমোদিত মূলধন ১২ হাজার কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৫ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। কিন্তু মূলধনে ঘাটতি রয়েছে ৪৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর গ্রাহক সংখ্যা ৯২ লাখ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ১৫ হাজারের বেশি।

গ্রাহক ও কর্মকর্তাদের অনিশ্চয়তা

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই একীভূতকরণ উদ্যোগ একদিকে বড় ও শক্তিশালী একটি ইসলামী ব্যাংক তৈরির সম্ভাবনা তৈরি করেছে, অন্যদিকে গ্রাহক ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা শঙ্কা। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, আমানতের নিরাপত্তা থাকবে কি না, আবার অনেকে চাকরি হারানোর ভয় পাচ্ছেন। ইতোমধ্যে কয়েকটি ব্যাংক আমানত হারাতে শুরু করেছে।

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের একজন গ্রাহক মো. রাকিব ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি ১০ লাখ টাকা আমানত রেখেছিলাম। গত দশ মাস ধরে ঘুরছি, কিন্তু টাকা তুলতে পারছি না। এখন শুনলাম সরকার ব্যাংকটা নিয়ে নিচ্ছে। গভর্নর বলেছেন টাকা ফেরত পাবো, কিন্তু কবে পাবো সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’ 

একই রকম উদ্বেগ রয়েছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যেও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, শুনছি একীভূত হলে সিনিয়রদের অনেকে চাকরি হারাবে। কে থাকবে, কে যাবে—তা এখনো স্পষ্ট না। ২০ বছর চাকরি করছি। চাকরি চলে গেলে পরিবার নিয়ে বড় বিপদে পড়ব।

এক্সিম ব্যাংকের আপত্তি

একীভূতকরণের প্রস্তাবে এক্সিম ব্যাংক প্রকাশ্যে আপত্তি জানিয়েছে। তাদের দাবি, এক্সিম একটি শক্তিশালী ও স্বনির্ভর ব্যাংক এবং অন্য দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়া তাদের জন্য ক্ষতিকর হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের করা অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (AQR) প্রতিবেদনে এক্সিম ব্যাংকের পরিস্থিতিও খুব ভালো নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক্সিম ব্যাংকের ৫২ হাজার ৭৬ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ অর্থাৎ ২৫ হাজার ১০১ কোটি টাকা খেলাপি। তাদের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ১৫ হাজার ১১৭ কোটি টাকা এবং লোকসান ৪০৯ কোটি টাকা।

আইএমএফের চাপ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যদি ৩০ শতাংশের বেশি হয়, তবে সেটিকে ‘মৃত ব্যাংক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়— যাকে বা তো বিলুপ্ত করতে হবে, না হলে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।
এই পাঁচ ব্যাংকের প্রত্যেকটিই সেই সীমা অতিক্রম করেছে। তাই অনেকেই মনে করছেন, আইএমএফের চাপ ও দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতেই বাংলাদেশ ব্যাংক মার্জার উদ্যোগ নিয়েছে।

গভর্নরের আশ্বাস

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, এই মার্জার প্রক্রিয়ার সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, কয়েক মাসের মধ্যেই বাস্তবায়ন হবে।

তিনি আরও বলেন, এই মার্জারে কারও চাকরি যাবে না। শুধুমাত্র অতিরিক্ত শাখাগুলো শহর থেকে গ্রামে স্থানান্তর করা হতে পারে।

বিশ্লেষকদের মত

একজন ব্যাংক বিশ্লেষক বলেন, এই পাঁচ ব্যাংক একীভূত হলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে একটি বড় ইসলামী ব্যাংক তৈরি হবে। শাখা, গ্রাহক, কর্মকর্তা ও সম্পদের দিক দিয়ে এটি হবে দেশের অন্যতম বৃহৎ ব্যাংক। দুর্বল অ্যাসেটগুলো আলাদা ব্যবস্থাপনায় আনা হবে এবং মূলধন ঘাটতি পূরণেরও পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

সম্ভাব্য সুফল

নতুন একীভূত ব্যাংকের অধীনে থাকবে ৭৭৯টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ৫০০টি এজেন্ট আউটলেট এবং ১,০০০টির বেশি এটিএম বুথ। এটি দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংক হবে, যা শহরের পাশাপাশি গ্রামের অর্থনীতিতেও বড় ভূমিকা রাখবে।

এতে করে খরচ কমবে, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে এবং দক্ষ জনবল ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়বে। সার্বিকভাবে এই উদ্যোগ ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

একিউআর অনুযায়ী পাঁচ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা—

এক্সিম ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ অনুযায়ী, এক্সিম ব্যাংকের মোট আমানত রয়েছে ৪২ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা। এই ব্যাংকটি ঋণ বিতরণ করেছে ৫১ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা, যার মধ্যে ২৫ হাজার ১০১ কোটি টাকা এখন খেলাপি—যা মোট ঋণের প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি (৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ)। এছাড়া এক্সিম ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ১৫ হাজার ১১৭ কোটি টাকা এবং বর্তমানে ব্যাংকটি ৪০৯ কোটি টাকা লোকসানে রয়েছে। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ১ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা এবং বর্তমানে এর শাখা সংখ্যা ১৫৫টি।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক অবস্থাও বেশ সংকটাপন্ন। ব্যাংকটির মোট আমানত রয়েছে ৩০ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, এবং বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৩৫ হাজার ২২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৩ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকাই খেলাপি ঋণ হিসেবে বিবেচিত, যা ঋণের বিশাল অংশ। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ১ হাজার ১৪০ কোটি টাকা এবং বর্তমানে এটি ৫৩ কোটি টাকা লোকসানে রয়েছে। ব্যাংকটির শাখা রয়েছে ১৮১টি।

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক

এই ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ১২ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা এবং ঋণ বিতরণ করেছে ১৪ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকাই খেলাপি ঋণ, যা প্রায় সব ঋণই অনাদায়ি অবস্থায় রয়েছে। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ৯৮৭ কোটি টাকা। এই মুহূর্তে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক লোকসানে আছে ২১৪ কোটি টাকা এবং এর শাখা সংখ্যা ১০৪টি।

ইউনিয়ন ব্যাংক

ইউনিয়ন ব্যাংকেও ঋণের তুলনায় খেলাপির হার অত্যন্ত বেশি। ব্যাংকটির মোট আমানত ১৭ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা হলেও ঋণ বিতরণ করেছে ২৮ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৬ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা এখন খেলাপি হিসেবে বিবেচিত। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা এবং বর্তমানে লোকসানে রয়েছে ৮০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির শাখা রয়েছে ১১৪টি।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক

এই ব্যাংকটি আমানত সংগ্রহ করেছে ৪৩ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা এবং বিতরণ করেছে ৬০ হাজার ৯১৫ কোটি টাকার ঋণ। এর মধ্যে ৫৮ হাজার ১৮২ কোটি টাকা অর্থাৎ প্রায় সব ঋণই খেলাপি হয়ে গেছে। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ১ হাজার ২০৮ কোটি টাকা এবং বর্তমানে ব্যাংকটি লোকসানে রয়েছে ৪০৫ কোটি টাকা। শাখা রয়েছে ২০৬টি।
News Source
 
 
 
 
Today's Other News
• একীভূত হলে অনিশ্চয়তায় পড়বে ব্যাংকের গ্রাহকরা
• পাঁচ ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সিআইপিসিতে অভিযোগ
• এনআরবিসি ব্যাংকে চাকরি, ৪৫ বছরেও করা যাবে আবেদন
• একীভূতকরণে আগ্রহী নয় এক্সিম ব্যাংক
• খেলাপিতে ডুবলেও মার্জারে নতুন সম্ভাবনা দেখছে ৫ ব্যাংক
• ‘এএএ’ ক্রেডিট রেটিং পেয়েছে প্রাইম ব্যাংক
• গ্রাহকবান্ধব সেবায় এগিয়ে যাচ্ছে ট্রাস্ট ব্যাংক
• ইউসিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ উদ্যোক্তা উন্নয়ন কর্মসূচির উদ্বোধন
• আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ৪২৯তম পর্ষদ সভা অনুষ্ঠিত
• এনআরবিসি ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত
More
Related Stories
 
Forward to Friend Print Close Add to Archive Personal Archive  
Forward to Friend Print Close Add to Archive Personal Archive  
 
 
Home / About Us / Benifits / Invite a Friend / Policy
Copyright © Hawker 2013-2012, Allright Reserved