প্রতি বছর জুনে পরবর্তী অর্থবছরের জন্য বাজেট জাতীয়
সংসদে পেশ করেন অর্থমন্ত্রী। তা পাসও করা হয় একই মাসে। তবে অর্থবছরের
মাঝামাঝি সময়ে গিয়েই দেখা যায়, বাজেট বাস্তবায়নে করুণ চিত্র। অর্ধেক
সময়ে পেরিয়ে গেলেও যখন দেখা যায় বাজেটের এক-তৃতীয়াংশও বাস্তবায়িত
হয়নি, তখন তা সংশোধনে নামে অর্থ মন্ত্রণালয়। যদিও অর্থবছর শেষে সংশোধিত
বাজেটেরও পুরোটা বাস্তবায়িত হয় না।
এভাবেই প্রতি বছর বাজেটের একটা অংশ অবাস্তবায়িত থেকে যায়। এর মূল কারণ
দুটি। প্রথমত, সরকার কোনো বছরই বাজেটে নির্ধারিত রাজস্ব আয়ের
লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে না। গত এক দশকের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা
গেছে, রাজস্ব আয় হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৪ থেকে ৩০ শতাংশ কম।
দ্বিতীয়ত, সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ও প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ
অবাস্তবায়িত থেকে যায়। পরিচালন ব্যয়ও কিছুটা কাটছাঁট হয়। এতে বাজেটে
নির্ধারিত আয় ও ব্যয় কোনো লক্ষ্যমাত্রাই পূরণ হয় না।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত বাজেট
বাস্তবায়নের চিত্র বিশ্লেষণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়, যা ‘মধ্যমেয়াদি
সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি: ২০২৪-২৫ হতে ২০২৬-২৭’ শীর্ষক প্রকাশনায়
উঠে এসেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের সহায়ক প্রকাশনা হিসেবে
এটি গত ৬ জুন প্রকাশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারের রাজস্ব আয়ের
লক্ষ্যমাত্রা ও অর্জনের চিত্রও বিশ্লেষণ করা হয়েছে প্রকাশনাটিতে।
এতে দেখা যায়, ২০০৯-১০ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে
বাজেটের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এর মধ্যে সবচেয়ে কম
বাস্তবায়িত হয়েছে ২০১৬-১৭ অর্থবছর। ওই অর্থবছর বাজেটের প্রায় ৭৯ শতাংশ
বাস্তবায়িত হয়েছিল। বাস্তবায়িত না হওয়ার হার ছিল ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আর
বাজেট সর্বোচ্চ বাস্তবায়িত হয় ২০১০-১১ অর্থবছর। ওই অর্থবছর বাস্তবায়ন
হার ছিল প্রায় ৯৭ শতাংশ। মাত্র তিন শতাংশ বাস্তবায়িত হয়নি সে বছর।
তথ্যমতে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম
পূর্ণাঙ্গ বাজেট দেয় ২০০৯ সালের জুনে। ২০০৯-১০ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত
ওই বাজেটের আকার ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছর শেষে
বাস্তবায়িত হয় এক লাখ এক হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ক্ষমতা গ্রহণের
প্রথম বছরই মহাজোট সরকার বাজেটের ১০ দশমিক ৭৩ শতাংশ বাস্তবায়ন করতে
পারেনি। যদিও পরের অর্থবছর বাজেট বাস্তবায়নে বেশ সাফল্যই দেখায় সরকার।
২০১০-১১ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছিল এক লাখ ৩২ হাজার ১৭০
কোটি টাকা। এর মধ্যে বাস্তবায়িত হয় এক লাখ ২৮ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা।
অর্থাৎ বাজেট বাস্তবায়িত হয়েছিল ৯৭ দশমিক ০৫ শতাংশ। ওই অর্থবছর বাজেট
বাস্তবায়িত না হওয়ার হার ছিল মাত্র দুই দশমিক ৯৫ শতাংশ।
পরের দুই অর্থবছরও বাজেট বাস্তবায়ন চিত্র তুলনামূলক ভালো অবস্থায় ছিল।
এর মধ্যে ২০১১-১২ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছিল এক লাখ ৬৩
হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। তবে বাস্তবায়িত হয়েছিল মাত্র এক লাখ ৫২ হাজার ৪২৮
কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজেটের ৯৩ শতাংশের বেশি বাস্তবায়িত হয়েছিল।
বাস্তবায়িত হয়নি মাত্র ছয় দশমিক ৮২ শতাংশ। পরের অর্থবছর প্রস্তাবিত
বাজেটের আকার বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। তবে
বাস্তবায়িত হয় এক লাখ ৫২ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা বা ৯০ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
অর্থাৎ ওই অর্থবছর ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ বাজেট বাস্তবায়িত হয়নি। মহাজোট তথা
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ওই তিন বছরই বাজেট বাস্তবায়ন চিত্র সবচেয়ে ভালো
অবস্থায় ছিল।
এর পর থেকে বাজেট প্রস্তাবনা ও বাস্তবায়নের মাঝে পার্থক্য বাড়তে থাকে।
বিশেষ করে পরের চার বছর এ পার্থক্য ক্রমেই বেড়েছে। এর মধ্যে ২০১৩-১৪
অর্থবছর প্রথমবারের মতো বাজেটের আকার দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়ায়। যদিও
বাস্তবায়িত হয়েছে অনেক। ২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার
ছিল দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। তবে বাস্তবায়িত হয় এক লাখ ৮৮ হাজার
২০৮ কোটি টাকা বা ৮৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অর্থাৎ বাজেটের ১৫ দশমিক ৪১ শতাংশ
বাস্তবায়িত হয়নি।
২০১৪-১৫ অর্থবছর প্রস্তাবিত বাজেটের আকার আড়াই লাখ কোটি ছাড়ায়। তবে
বাস্তবায়িত হয় দুই লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি। ওই অর্থবছর প্রস্তাবিত ও
বাস্তবায়িত বাজেটের আকার ছিল যথাক্রমে দুই লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি ও দুই
লাখ চার হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজেট বাস্তবায়িত হয় ৮১ দশমিক ৫৯
শতাংশ। সে অর্থবছর বাজেটের ১৮ দশমিক ৪১ শতাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। পরের দুই
অর্থবছর এ হার আরও বেড়েছে।
২০১৫-১৬ অর্থবছর প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছিল দুই লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি
টাকা। তবে বাস্তবায়িত হয় দুই লাখ ৩৮ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা বা ৮০ দশমিক ৮০
শতাংশ। অর্থাৎ ১৯ দশমিক ২০ শতাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১৬-১৭ অর্থবছর
প্রস্তাবিত বাজেটের আকার তিন লাখ কোটি ও বাস্তবায়ন আড়াই লাখ কোটি টাকা
অতিক্রম করে। ওই অর্থবছর প্রস্তাবিত বাজেট ছিল তিন লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি
টাকা, যার মধ্যে বাস্তবায়িত হয় মাত্র দুই লাখ ৬৯ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা।
অর্থাৎ বাস্তবায়িত হয় ৭৯ দশমিক ১২ শতাংশ, যা বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে
সবচেয়ে কম।
২০১৭-১৮ অর্থবছর প্রস্তাবিত বাজেটের আকার চার লাখ কোটি ও বাস্তবায়ন তিন
লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করে। ওই অর্থবছর প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছিল চার
লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। তবে বাস্তবায়িত হয় তিন লাখ ২১ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা বা
৮০ দশমিক ৪১ শতাংশ। অর্থাৎ ১৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ বাজেট বাস্তবায়িত হয়নি ওই
অর্থবছর। ২০১৮-১৯ অর্থবছর বাজেট বাস্তবায়নের হার কিছুটা বৃদ্ধি পায়। ওই
অর্থবছর প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছিল চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা ও
বাস্তবায়িত হয় তিন লাখ ৯১ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাস্তবায়নের হার
ছিল ৮৪ দশমিক ৩১ শতাংশ। ওই অর্থবছর বাজেট বাস্তবায়নে বিচ্যুতি ছিল ১৫
দশমিক ৬৯ শতাংশ।
পরের দুই বছর আবারও বাজেট বাস্তবায়নের হার হ্রাস পায়। এর মধ্যে
২০১৯-২০ অর্থবছর প্রথমবারের মতো প্রস্তাবিত বাজেটের আকার পাঁচ লাখ কোটি
টাকা অতিক্রম করে। আর বাস্তবায়ন ছাড়ায় চার লাখ কোটি টাকা। যদিও করোনার
জন্য ওই অর্থবছরের জানুয়ারি থেকে অর্থনৈতিক কার্যক্রম সীমিত হতে শুরু করে।
আর শেষ তিন মাস অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রায় বন্ধই ছিল। ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি
থাকার প্রভাব পড়ে সরকারের রাজস্ব আয় ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে।
২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ছিল পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি
টাকা। আর বাস্তবায়িত হয় চার লাখ ২০ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজেট
বাস্তবায়িত হয়েছিল ৮০ দশমিক ৩১ শতাংশ। বাজেট বাস্তবায়িত না হওয়ার আকার
প্রথমবার এক লাখ কোটি টাকা ছাড়ায়। ওই অর্থবছর বাজেট বাস্তবায়নে বিচ্যুতি
ছিল এক লাখ তিন হাজার ৩০ কোটি টাকা বা ১৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
আমদানি-রপ্তানিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ধস নেমেছিল ওই
অর্থবছর।
করোনার ধাক্কা পরের অর্থবছরও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষত
সৃষ্টি করে। ২০২০-২১ অর্থবছর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের গতিও ছিল অনেক
ধীর। অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্যক্রম সীমিত আকারে শুরু হলেও পরিস্থিতি
স্বাভাবিক হতে পুরো অর্থবছরই লেগে যায়। ওই অর্থবছর প্রস্তাবিত বাজেটের
আকার ছিল পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। তবে বাস্তবায়িত হয় চার লাখ ৬০
হাজার ১৬০ কোটি টাকা বা প্রায় ৮১ শতাংশ। আকারের দিক থেকে ওই অর্থবছর
সবচেয়ে বেশি বাজেট অবাস্তবায়িত থাকে, যার পরিমাণ ছিল এক লাখ সাত হাজার
৮৪০ কোটি টাকা। বাস্তবায়নে বিচ্যুতির হার ছিল ১৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় পরের দুই অর্থবছর বাজেট বাস্তবায়ন কিছুটা
বাড়ে। এর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছর প্রস্তাবিত বাজেটের আকার প্রথম ছয় লাখ
কোটি টাকা ছাড়ায়। তবে বাস্তবায়ন ছাড়ায় পাঁচ লাখ কোটি টাকা। ওই অর্থবছর
এ দুটির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা ও পাঁচ লাখ
১৮ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজেট বাস্তবায়িত হয় ৮৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
বিচ্যুতির হার ছিল ১৪ দশমিক ১৬ শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছিল ছয় লাখ ৭৮ হাজার
৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাস্তবায়িত হয় পাঁচ লাখ ৭৩ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা
বা ৮৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। অর্থাৎ ওই অর্থবছর বাজেটের ১৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ
বাস্তবায়িত হয়নি। তবে বাজেটের আকার বাড়তে থাকায় পরিমাণের দিক থেকে গত
অর্থবছর বাজেট বাস্তবায়নে বিচ্যুতি ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এক লাখ চার
হাজার ২০৭ কোটি টাকা। ওই অর্থবছর সরকারের পরিচালন ব্যয় লক্ষ্যমাত্রার
চেয়ে চার দশমিক ৩৩ শতাংশ কম ছিল। তবে উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়ন
লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২২ শতাংশ কম হয়। মূলত এর প্রভাবে বাজেট বাস্তবায়ন
অনেক কম হয়।
বাজেট বিচ্যুতি প্রসঙ্গে মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে
বলা হয়েছে, পরিকল্পিত আয়-ব্যয় থেকে প্রকৃত আয়-ব্যয়ের পার্থক্য
বিশ্লেষণের মাধ্যমে অগ্রাধিকার ও খাতভিত্তিক ব্যয়ের একটি ধারণা পাওয়া
যায়, যা ভবিষ্যতে সঠিকভাবে বাজেট প্রস্তুতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
রাখবে।