[ মতামত ] 26/03/2023
 
খেলাপি ঋণ আদায়: প্রয়োজন সহায়ক পরিকল্পনা ও নীতিমালা
মহিউদ্দিন আহমেদ

‘দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’ বা ‘বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না’ এই ধরনের প্রবাদ ব্যাংকিং খাতের জন্য প্রযোজ্য নয়। আমানত সংগ্রহ এবং ঋণ দেয়াই ব্যাংকের প্রধান কাজ। ব্যাংকিংয়ে আয়ের প্রধান উৎস হলো ঋণের বিপরীতে সুদ; যেখান থেকে আমানতকারীদেরকে আমানত সুদ দিতে হয়, পরিচালন ব্যয় মেটাতে হয়, সব ব্যয় মিটিয়ে যা মুনাফা থাকে, তার থেকে শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড দিতে হয় এবং সরকারকে কর্পোরেট ট্যাক্স দিতে হয়। অতএব গোয়াল খালি রাখার কোনো উপায় নেই, বরং দুষ্টু গরু/খারাপ লোনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, যা ব্যাংক খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জও বটে।

ঋণ দেয়ার পরবর্তী কাজ ঋণ আদায়-এটা যতখানি সত্য, এটা খুব সহজ কাজ নয় সেইটাও সত্য। দেশের ব্যাংক খাতের প্রায় ২১ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে, মামলা-মোকাদ্দমার মাধ্যমেও এগুলো আদায় হচ্ছে না। ঋণ আদায় করতে গিয়ে ব্যাংকাররা বিভিন্ন বিরুপ অবস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন।

‘দুই ব্যাংক কর্মকর্তা গেলেন এক খেলাপি ঋণ গ্রহীতার বাসায় টাকা আদায়ের জন্য। ঋণ গ্রহীতা স্থানীয় লোকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে চাঁদাবাজির ধোয়া তুলে গণপিটুনির আয়োজন করেছিলেন।’ ‘বড় অংকের ঋণখেলাপী একজনের কাছে যাওয়া হলো ব্যাংক থেকে ঋণ পরিশোধের তাগাদা দেয়ার জন্য, পরিবার থেকে জানানো হলো ‘উনি অসুস্থ, ডিমেনশিয়া সন্দেহ করা হচ্ছে’। ব্যাংকারের গা শিউরে উঠলো, তার মানে কোন ব্যাংক থেকে কতো টাকা নিয়েছেন তা কিছুই মনে করতে পারবেন না!’

‘খেলাপি ঋণ গ্রাহকের কাছে সাড়া না পেয়ে ব্যাংক থেকে প্রথম জামিনদার ঋণ গ্রহীতার স্ত্রীকে ফোন দেয়া হলো। স্ত্রী ‘আজ আমার মন ভালো নাই’ টাইপ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে’! ব্যাংকার চিন্তা করছেন, লোনের টাকা না দিয়ে কেনো তারা সংসার ভাঙতে গেলো?’

ঋণ বিভিন্ন কারণে খেলাপি হয়েছে, যেমনঃ করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদি- এগুলো অনিয়ন্ত্রাণাধীন এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সময়-অসময়ে বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়ে ব্যবসায়ীদের পাশে থেকেছেন, যদিও প্রণোদনার লোনগুলোও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনাদায়ী থাকাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে প্রচলিত ব্যাংক সুদে দীর্ঘ মেয়াদি কিস্তি লোনে রূপান্তর করতে হয়েছে। করোনার পর বিদেশে জনবলের চাহিদা বাড়ায় এক শ্রেণির ‘স্বেচ্ছায় খেলাপি’ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, যাদের মধ্যে ব্যবসায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উচ্চ পদস্থ কর্পোরেট থেকে শুরু করে অসাধু ব্যাংকারও আছেন।

এই টাকাগুলো আদায় যত কষ্টসাধ্যই হউক না কেন তা ফেরত আনার উপায় বের করতে হবে, কারণ এগুলো জনগণের টাকা।   

বর্তমানে ব্যাংক এর অর্থ মামলা কম-বেশি ২ লাখ ৭৭ হাজার, যাদের সবাই ইচ্ছাকৃত খেলাপি নয়, অনেক সময় তারা পরিস্থিতির শিকারও হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক  ড. আর এম দেবনাথ যথার্থই বলেছেন, “যেই অংকে লোন শ্রেণিবিন্যাস/ প্রভিশনিং হয়, সেই অংকে ব্যবসা চলে না”। মাননীয় অর্থমন্ত্রী হয়তো এই ব্যাপারটাকেই মাথায় রেখে ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছেন, ২০১৯ সালে ২% ডাউন পেমেন্টে ১ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছর মেয়াদে খেলাপি ঋণ  ‘নিয়মিত’ করার সুযোগ দিয়েছেন, সর্বশেষ বিআরপিডি সার্কুলার ১৬, ২০২২ এর মাধ্যমে মাত্র ২-৪% ডাউনপেমেন্টে পুনঃতফসিল সুবিধা ও ২০২২ সালে প্রদেয় কিস্তির অর্ধেক পরিশোধে রেগুলার হওয়ার সুবিধা দিয়েছেন এবং এই পলিসির আওতায় প্রায় ১৪০০০ কোটি খেলাপি ঋণ কাগুজে কমে গেছে।

সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবরই ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যাংকিং-এ গতিশীলতা নিশ্চিত করতে ‘আন্তরিক’ প্রজ্ঞাপন জারী করছেন, তবে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ব্যাংকগুলোর প্রকৃত অবস্থা জানতে পারছেন না বলে ‘উষ্মা’ প্রকাশ করেছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল কর্তৃক ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেয়ার প্রাক্কালে খেলাপি ঋণ নিয়ে দাতা গোষ্ঠীর অনেক উদ্বিগ্নতা সামনে এসেছে, পাশাপাশি অনেক সংস্কার পরামর্শ এসেছে, সরকারের পক্ষ থেকেও অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। আগামী ২০২৬ পর্যন্ত দাতাগোষ্ঠীর নজর থাকবে এই অবস্থার উন্নয়নে সরকার কী ধরনের ঋণ-সংস্কার পদক্ষেপ নিচ্ছে তার দিকে। খেলাপি ঋণ আদায়ে তাই সরকারের স্বদিচ্ছা থাকবে-এটা সহজেই অনুমেয়, এইক্ষেত্রে সহায়ক কিছু নীতিমালা/পরিকল্পনা খেলাপি ঋণ প্রকৃতপক্ষেই কমাতে সহায়ক হবে।  

১। ঝুঁকিপূর্ণ এবং বৃহৎ ঋণগুলোকে বীমার আওতায় আনা, যেন ব্যবসার যেকোনো দৈব পরিস্থিতিতে কিংবা মালিকের মারা যাওয়ার কারণে ঋণ পরিশোধ নিয়ে পরিবার বা ব্যাংক বিপাকে না পড়ে। ঋণ বীমা নিতে উৎসাহিত করতে ঋণের সুদ কম নেয়া যেতে পারে, কারণ ঋণের ঝুঁকি কমলে ঝুঁকি অধিহার (রিস্ক প্রিমিয়াম) কম আসে।

২। ইতিমধ্যে জমির মিউটেশন, খাজনা ইত্যাদি অনলাইনভিত্তিক হয়ে গেছে, যা সরকারের অনেক বড় সাফল্য। এইক্ষেত্রে ‘বন্ধকী ব্যাংকের তথ্য’ সন্নিবেশিত করা গেলে সহজেই সম্পত্তি কেনা/বেচা বা হস্তান্তরে আগ্রহী ক্রেতা বা বন্ধক নেয়ার আগে ব্যাংক জানতে পারবেন যে এই সম্পত্তি কেনা/বন্ধক নেয়া যাবে কিনা। আবার খেলাপি ঋণের তথ্য ভূমি অফিস, ভূমি নিবন্ধন অফিস বা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস গ্রহণ করলে সরকারের স্বদিচ্ছায় খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে আটকে দেয়া যাবে এবং খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে বাধ্য করা যাবে, যেমনটা করে জমি কেনা/বেচায় সরকার প্রথমে ‘করদাতা শনাক্তকরণ নাম্বার’ (TIN) থাকা এবং এখন আয়কর রিটার্ণ দাখিল বাধ্যতামূলক করেছেন।   

৩। খেলাপি ঋণের তথ্য জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান যেমনঃ ওয়াসা, ডেসা, ডেসকো, তিতাস ইত্যাদিতে থাকলে সরকার খেলাপি গ্রাহককে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদির মতো জরুরি সেবা পেতে লোন রেগুলার করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারেন।

৪। খেলাপি ঋণের তথ্য ইমিগ্রেশনে থাকলে এবং ঋণগ্রহীতার জন্য বিদেশ ভ্রমণে ব্যাংক অনাপত্তি সনদ নেয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করলে ঋণ আদায় অটোমেটেড প্রক্রিয়ায় সম্ভব। নেপালে খেলাপিরা পাসপোর্টই পান না।

৫। ভালো গ্রহীতাদের জন্য ‘সুদ অবহার (Tax Rebate)’ সুবিধা আরও বিস্তৃতভাবে চালু করে উৎসাহ দেয়া যেতে পারে। BRPD সার্কুলার ০৬, তারিখ ১৯/০৩/২০১৫তে ভালো গ্রহীতা (GOOD BORROWER) দেরকে আদায়কৃত সুদের উপর ১০% সুদ ফেরত দেয়ার ঘোষণা করা হয়েছিল যা ব্যাংকগুলো স্ব-উদ্যেগে করবেন। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে আমানত-সুদের হার ৬%- ৯% করার পর এই সুবিধা রহিত করা হয়। এক্ষণে সুদের হার বাড়ানোর কারণে ভালো গ্রহীতাদেরকে মূল্যায়িত করার জন্য এই সুবিধা চালু করা উচিত।

৬। ইতিমধ্যে অনেক নেতিবাচকতার মধ্যেই ভোক্তা ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। লোনের মেয়াদগুলো বাড়ানো না হলে ঋণ পরিশোধ চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে এবং খেলাপি ঋণ বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকবে। বর্তমানে ‘সময় ঋণ’ (Time Loan) গুলোর সর্বোচ্চ মেয়াদ ১ বছর, স্বল্পমেয়াদি ঋণগুলোর ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। এগুলোর মেয়াদ বাস্তবতার নিরিখে পরিশোধের সুবিধার্থে বাড়ানো যেতে পারে, তবে ঢালাওভাবে করলে ব্যাংকগুলোর টাকা আটকে যাবে ঋণ গ্রহীতাদের কাছে, পুনঃঅর্থায়নের জন্য সংহতি তহবিল (Mobilization Fund) কমে যাবে।

৭। প্রতিটি ব্যাংকেই প্রজেক্ট কস্ট এসেস করার জন্য বা কাজের অগ্রগতি নিরুপণের জন্য পুরোকৌশল প্রকৌশলী থাকা জরুরি। কাজের অগ্রগতির উপর ভিত্তি করেই ধাপে ধাপে ঋণের টাকা ছাড় করা হয়। অতি বিনিয়োগের (Over Financing) কারণে ঋণের টাকা সরিয়ে নেয়ার (Fund Divert) সুযোগ থাকে, যা আদায় অসম্ভব হয়ে পড়বে পরে। পাশাপাশি জমির মূল্যায়নের জন্য ব্যাংকের তালিকাভুক্ত সার্ভেয়ারদেরকে আরও দায়িত্বশীলতা এবং জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। তবে অতিমাত্রায় সংরক্ষণশীল মনোভাব থেকে কম অর্থায়ন (Under Financing) করলেও প্রজেক্ট ব্যর্থ হতে পারে। শিল্পের গড় বিশ্লেষণ করে ন্যয়সঙ্গত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।  

৮। লোন বিতরণের পূর্বে ঋণ গ্রহীতা/গ্রহীতাদের পাশাপাশি তাদের পরিবারের সবাইর ব্যক্তিগত তথ্য নিতে হবে যেন যেকোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে খুঁজে পাওয়া যায়, যেমন স্বামী/স্ত্রীর যোগাযোগ নাম্বার, ইমেইল, পেশার তথ্য, সন্তানের একাডেমিক তথ্য, নিকটাত্মীয়দের তথ্য, স্থায়ীভাবে বসবাসকারী আত্মীয়দের তথ্য ইত্যাদি। খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদেরকে অনেক সময়ই ঋণ নেয়ার সময় তার ঘোষিত ঠিকানায় পাওয়া যায় না, ঋণ আদায়ে এটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

৯। লোন দেয়ার ক্ষেত্রে এসএমই গ্রাহকদেরকে বিশেষভাবে পরিচর্যা করতে হবে, কারণ অনেক ক্ষেত্রেই উনাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকে না এবং নিজেদের ব্যবসার হিসাব ঠিকমতো রাখতে পারেন না। সারা দেশে অঞ্চলভিত্তিক ক্যাম্পেইন করে সেরা ব্যবসায়িক আইডিয়াগুলোতে স্টার্ট আপ ফাইন্যন্স করা যেতে পারে। ব্যাংকগুলো নিজেরা এইসব উদ্যেক্তাদেরকে  ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্স, ব্যবসায়িক চিঠিপত্র লিখনী, বিপণন কৌশল ইত্যাদির উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের সক্ষমতা বাড়াতে পারেন। ব্যবসা ভালো করলে এবং মনিটরিংয়ে রাখলে ক্ষুদ্র গ্রাহকরা বড় গ্রাহক হলেও ঋণ শিষ্টাচারের প্রতি অনুগত থাকবেন, খেলাপি না হওয়ার চেষ্টা করবেন।  

১০। গ্রাহকরা ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন ব্যাংকারদের ঋণ প্রসার ও ঋণ আদায় লক্ষ্যমাত্রা থাকে। অনেক ব্যাংকারদেরই অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, কিছু খেলাপি ঋণ গ্রহীতা অপেক্ষা করেন বছর শেষে ব্যাংক ক্লোজিং এর সময় কীভাবে সুদ মওকুফ আদায় করা যায়। লোন অনুমোদনের সময়ও অনেক সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদেরকে ব্যাংকিং নীতিমালার সঙ্গে আপস করার কুইঙ্গিত দেন এই ধরনের গ্রাহকরা। ব্যাংক ব্যবস্থা কেন্দ্রীভূতকরণ (Centralization) প্রক্রিয়া এই ক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তি দিলেও অনুমোদন প্রক্রিয়াকে বিভিন্ন সূচক নির্ধারণপূর্বক স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে করা গেলে ব্যাংকে এক ধরনের নৈতিক পরিবেশ তৈরি হলে, গ্রাহকরা নিজেরাও ব্যাংকিং শৃঙ্খলায় অভ্যস্ত হবেন।

১১। কোনো ঋণ একদিনেই খারাপ হয় না, তাই ‘সমসাময়িক নিরীক্ষা’ (Concurrent Audit) ব্যবস্থাকে আরও জোরালো করতে হবে, সাপ্তাহিক/পাক্ষিক/বা মাসিক ভিত্তিক করা যেতে পারে এবং  প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠাতে হবে। একদল দক্ষ, নম্র, ব্যাংকিং আইনের প্রতি অনুগত ব্যংকারদের মাধ্যমে ঋণ দলিলাদি সম্পন্নকরণ, লোনের জন্য আবশ্যিক কাগজ সংগ্রহ, মজুতকৃত মালামাল যাচাইকরণ, ব্যবসায় বেচাকেনা পর্যবেক্ষণ, রশিদ সংরক্ষণ ইত্যাদি নিরীক্ষা করানো যেতে পারে।

১২। অর্থ মামলা নিষ্পত্তিতে এবং দীর্ঘসূত্রিতা কমাতে আদালতের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন এবং পাশাপাশি মামলা নিষ্পত্তির সময়সীমা বেঁধে দেয়া দরকার। অনেক ঋণখেলাপী ব্যাংকে মহামান্য উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ এনে পুনরায় লোন নেয়ার প্রচেষ্টা চালান, নিম্ন আদালতে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হতেই কয়েক বছর লেগে যায় অনেক ক্ষেত্রে, খেলাপিরা বার বার সময় প্রার্থনা করে বিচারিক প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করেন।

১৩। মামলা এড়িয়ে ব্যবসায়িক সংগঠন, বণিক সমিত, মহল্লা উন্নয়ন কমিটি, পঞ্চায়েত বা ফ্ল্যাট মালিক সমিতি যেখানে যেইটা প্রযোজ্য তাদের সহযোগিতা নিয়ে সামাজিকভাবে খেলাপি ঋণ আদায় ভালো ফল বয়ে আনতে পারে।  

১৪। লীজ সম্পত্তি বন্ধক রেখে লোন পেতে ঋণ গ্রহীতাকে লীজ কর্তৃপক্ষ যেমনঃ রাজউক, গণপূর্ত, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান থেকে বন্ধক অনুমতি নিতে হয় এবং খেলাপি ঋণ আদায়ে নিলাম করার প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে নিলাম অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন হয়। এই অনুমতি পাওয়ার প্রক্রিয়াটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাংকগুলোর কাছে ‘কঠিন-সাধ্য’ এবং ‘ব্যয়বহুল’ মনে হয়। এই জায়গায় কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা ও দ্রুততা খেলাপি ঋণ আদায়ে  সহায়ক করবে।

১৫। কিছু ক্ষেত্রে, ঋণ গ্রহীতার মৃত্যুর কারণে বা করোনা/অনিয়ন্ত্রণাধীন কারণে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়া/ হঠাৎ বিদেশি গ্রাহক হারানোর (লেদার ওয়ারকিং গ্রুপ সম্মতি সনদ না থাকার কারণে ট্যানারী ব্যবসায়ীরা এ ধরনের সমস্যায় পড়েছেন) মতো ইস্যু থাকে। এসব ক্ষেত্রে বিক্রয় প্রাপ্যগুলো আদায় করে কিংবা বন্ধকী/স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যাংক লোন সমন্বয়ের উদ্যেগ নিতে হয় গ্রাহককে বা বন্ধকী ব্যাংককে। পুনঃতফসিলের সর্বশেষ মাস্টার সার্কুলার অনুযায়ী, গ্রেস পিরিয়ডসহ দীর্ঘ মেয়াদি কিস্তিতে পরিশোধের সুবিধা থাকলেও পুনঃতফসিলের শর্তাবলী অনুযায়ী তারল্য বিবরণী, আয়-ব্যয় বিবরণী, মজুত মালামালের বিবরণী ইত্যাদি প্রদান তাদের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয় না, কারণ ব্যবসা চলমান নাই।

গতানুগতিক ধারায় কোনোভাবে পুনঃতফসিল করলেও নিয়মিত কিস্তি দিতে না পারার কারণে আবারো খেলাপি হয়ে যায়, কারণ তার ঋণ পরিশোধ স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে পরিশোধ হওয়ার কথা। এই ধরনের খেলাপি গ্রাহকদের চলমান ঋণ সীমা/স্থিতি পরিশোধের সুবিধার্থে খেলাপি চিহ্নিত না করে ২%-৪% ডাউনপেমেন্ট নিয়ে ‘সমন্বয়ের উদ্দ্যশ্যে নবায়ন’ করা গেলে এবং গ্রাহককে বাস্তবতার নিরিখে কিছু এলসি/গ্যারান্টি সুবিধা দেয়া গেলে তারা ব্যবসাটা চালু রাখার চেষ্টা করতে পারেন। স্বতঃসিদ্ধ প্রথা হলো, ব্যবসা কোথাও আটকে গেলে মার্কেট থেকে ধারে পণ্য বিক্রির টাকা আর আদায় হয় না, এমনকি ডিলার বা রিটেইলারদের থেকেও সহযোগিতা পাওয়া যায় না।

ফলে ব্যবসায়ীর সংকট আরও প্রবল হয়। অন্যদিকে ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ‘অংকের হিসাবে’ গ্রাহককে খেলাপি করার কারণে ব্যাংকের বাড়তি প্রভিশন রাখতে হয় এবং ব্যাংকের স্টেইকহোল্ডারদের কাছে অস্পষ্ট বার্তা যায়, যার প্রভাব মানি মার্কেট, ক্যাপিটাল মার্কেট সর্বত্র। এই ধরনের খেলাপি গ্রাহকদের জন্য বিশেষ কোনো নামে সিআইবি রিপোর্টিং করা যেতে পারে যেন অন্য ব্যাংক সহজেই তার স্ট্যাটাস বুঝতে পারে।

১৬। বিগত কয়েক বছরে সরকারের অনেক উন্নয়ন কর্মকা-ে ব্যাংকগুলো সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে  বিনিয়োগ এর মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগী হিসাবে কাজ করে আসছে। ডলার সংকট, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি সব এক সুতায় জড়িয়ে গেছে, ফলে প্রজেক্টের প্রকৃত ব্যয় অনুমোদিত ব্যয় বাজেটকে ছাড়িয়ে গেছে। এমতাবস্থায় মূল্য সমন্বয়পূর্বক প্রজেক্টের বাজেট পুনঃনির্ধারণ না করলে ঠিকাদাররা ক্ষতির সম্মুখীন হবে/হচ্ছে এবং পরিণামে ব্যাংক ঋণগুলো খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বেশকিছু নির্দেশনা দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিচালন পর্ষদকে সব ক্ষমতা অর্পণ করে ভারমুক্ত হয়েছেন। বিগত কয়েক বছরে মানুষ করোনা, যুদ্ধ, বন্যা, মহামারি সবই দেখেছে যা দূর অতীতেও দেখা যায় নাই। সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক সাধারণ শ্রমিকের মাসিক বেতন মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে পৌঁছানোসহ ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসাবান্ধব অনেক প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছেন এবং ঋণ পরিশোধ অবকাশ সুবিধা দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক অভিভাবকের আসনে বসে যেই সাহসিকতা, মানবিকতা ও দায়িত্বশীলতা দেখিয়েছেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সেই ধরনের কিছু উদ্যেগ/সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক পাশে থাকবে এই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট সবাইর।
[email protected]