[ অনলাইন (সম্পাদকীয় ) ] 27/07/2024
 
ব্যাংক খাতের ক্ষত উপশমে চাই সুশাসন
অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ব্যাংক খাত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বহুমাত্রিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পাশাপাশি প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে এই খাতে সৃষ্ট ক্ষতের উপশম কীভাবে করা সম্ভব? ফিরে ফিরে নেতিবাচক অর্থে সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে এই খাতটি। ২৫ জুলাই প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ বলা হয়েছে, জবাবদিহির ঘাটতিতে বাড়ছে অনিয়ম। ব্যাংক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি নতুন কিছু বিষয় নয় এবং বিশ্লেষকরা এজন্য তদারকি ব্যবস্থার দুর্বলতাকে দায়ী করেছেন। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অনিয়ম রুখতে তদারকি বাড়ানোর পরিবর্তে উল্টো কমছে ব্যাংকগুলোতে বিশেষ পরির্দশন। বিভিন্ন অভিযোগের নিষ্পত্তিও হচ্ছে ধীরগতিতে। প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলো আলোর মুখ দেখছে না- এও বলা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষমতাবানদের সহযোগিতার অভিযোগও নতুন কিছু নয়।

আমরা জানি, অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড হিসেবে ব্যাংক খাত বিবেচিত। হৃৎপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক থাকলে শরীর যেমন থাকে সুস্থ তেমনি ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা-স্বচ্ছতা-গতিশীলতা একই সঙ্গে পুষ্টতা অর্থনীতির রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখে। আমরা দেখছি, প্রভাবশালীদের সুবিধার্থে ব্যাংক খাতে অনেক নীতি প্রণীত হয় এবং ছাড় দেওয়া হয়, যা পরবর্তী সময়ে আবার পরিবর্তনও করতে হয়। এর ফলে এক ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার আগেই ফের নতুন ক্ষতির বার্তা এসে হাজির হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যে চিত্র উঠে এসেছে তা স্বস্তির নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফ প্রতিনিধিদল ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন অব্যাহত আছে কি না তা জানতে চেয়েছিল।

আমরা জানি, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অনিয়ম শনাক্তকরণে কাজ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্ট (এফআইসিএসডি)। উল্লেখ্য, এই প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের একমাত্র ডিপার্টমেন্ট, যেখানে গ্রাহকসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীও তাদের ব্যাংকিং লেনদেনসংক্রান্ত যেকোনো তথ্য অভিযোগ আকারে জানাতে পারে। ইতোমধ্যে ওখানে অনেক অভিযোগ এসেছে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে নিষ্পত্তির হার একেবারেই কম।

ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি একের পর এক অনিয়ম, দুর্নীতির ঘটনাগুলো বারবার প্রশ্ন উত্থাপন করেছে এত কদাচারের সুযোগ সৃষ্টি হয় কীভাবে? আমরা জানি, আমাদের অর্থনীতি তথা ব্যাংক খাতে অন্যতম উপসর্গ খেলাপি ঋণ। নিকট অতীতে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর এক প্রতিবেদনেই বলা হয়েছিল, খেলাপি ঋণ নিয়ে ব্যাংকগুলো তাদের আর্থিক চিত্র কৌশলে ভালো দেখাচ্ছে। আমরা মনে করি, এই কৌশল আত্মঘাতীর নামান্তর। খেলাপি ঋণ বাদ দিয়ে ব্যাংকের আর্থিক চিত্র ভালো দেখানোর ফল ভালো হতে পারে না। খেলাপি ঋণ নিয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফে নানারকম সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে বটে কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও সত্য, এর তেমন কোনো সুফল দৃশ্যমান হয়নি। লাগামহীন খেলাপি ঋণ, সুশাসনের ঘাটতি, জবাবদিহির সংস্কৃতিতে ভাটা ইত্যাদি কারণে ব্যাংকের ওপর থেকে সাধারণ মানুষের আস্থা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এই বার্তাও প্রীতিকর নয়।

দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে যাওয়ার অভিযোগ যেমন রয়েছে, তেমনি ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে লোপাট হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা- এই অভিযোগও আছে। অর্থ পাচার আমাদের অর্থনীতি তথা জাতীয় স্বার্থের জন্য বড় হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা দেখছি, তারল্য সংকটসহ নানামুখী জটিলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে এই খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানকে। নিকট অতীতে এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা বলেছি, ব্যাংক খাতের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিরসনে জবাবদিহির সংস্কৃতি পুষ্ট করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আমরা জানি, চলমান বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে আমাদের অর্থনীতিও অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং এর সুরাহা খুব দ্রুত হবে বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে তেমনটি আশা করা যায় না। অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঋণ কেলেঙ্কারি ঠেকাতে পরিদর্শনের মান ও সংখ্যা বাড়াতে পরামর্শ এসেছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের তরফে। সার্বিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলায় বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে- এমন অভিযোগ কয়েকজন নির্বাহী পরিচালকের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকাঠামোয় যদি শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে অন্য ব্যাংকগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরবে কীভাবে? আমরা মনে করি, সংকটের উৎসে নজর দিয়ে এর যথাযথ প্রতিবিধানে মনোযোগ গভীর করা বাঞ্ছনীয়। সুশাসনকে সর্বরোগের দাওয়াই হিসেবে অভিহিত করা যায়। আমরা আরও মনে করি, কেবল সুনীতির প্রতিপালনেই নিশ্চিত হতে পারে সুশাসন। আমরা বিশ্বাস করি, সুশাসনের আলো যত ছড়াবে অনিয়ম-দুর্নীতির ছায়াও ততই দ্রুত দূরীভূত হবে। জবাবদিহি নিশ্চিতকরণসহ আনুষঙ্গিক যা কিছু প্রয়োজন সেসবই করতে হবে নির্মোহ অবস্থান নিয়ে।

গত জানুয়ারিতে সংবাদমাধ্যমেই আমরা জেনেছিলাম, ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বড় ধরনের সংস্কার কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ‘ক্রমস্পট কানেকটিভ অ্যাকশন (পিসিএ)’ নামের একটি পরিকাঠামোর আওতায় দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করে সেসব ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু আমরা দেখেছি, অনেক সবল ব্যাংকই দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে আপত্তি উত্থাপন করেছিল। ব্যাংক খাতে সংস্কারের ব্যাপারে ইতোমধ্যে কথা হয়েছে যত, কাজ হয়নি তত। এর ফলে অনাচারী-দুরাচারী-অনিয়মকারীরা আরও বেশি সুযোগ পেয়ে যান। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ব্যাংক খাতে বিরূপ অভিঘাত লাগে। সুশাসনের অগ্রপ্রত্যয় যেমন সুনীতি তেমনি এর পরবর্তী প্রত্যয় হলো সুফল অর্জনের পথ নিরূপন। কিন্তু আমরা দেখছি, অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতিতে এসব ব্যাপারে দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত হলেও প্রকৃতপক্ষে কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি বা হচ্ছে না। বিশ্লেষক অনেকেরই ধারণা এরও বিরূপ প্রভাব পড়েছে ব্যাংক খাতে। এই খাতটি ঘিরে অনাকাঙ্ক্ষিত-অনভিপ্রেত ঘটনার যত ব্যাপ্তি ঘটছে ততই দ্রুত গ্রাহকের আস্থা সংগতকারণেই হ্রাস পাচ্ছে। সচেতন মানুষ মাত্রেরই অজানা নয়, ব্যাংক খাতে সৃষ্ট অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

গত জানুয়ারি মাসেই আর্থিক খাতের সুশাসন নিশ্চিতকরণ এবং খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরির কথা বলা হয়েছিল ঘোষিত মুদ্রানীতিতে। কিন্তু এ ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত কতটা কি হয়েছে তা আমাদের জানা নেই। আমরা মনে করি, এ খাতে সৃষ্ট সংকট নিরসনের স্থায়ী পদক্ষেপ হিসেবে খাতটিকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। এ খাতের সংস্কারে একটি কমিশন গঠনের দাবিও দীর্ঘদিনের। ব্যাংকের টাকা জনগণের টাকা। ব্যাংক শুধু এই আমানত রক্ষাকারী দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান। দেশের জনগণের টাকা বেহাত হোক কিংবা ফেরত না আসুক এমন বিশৃঙ্খলা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। অনিয়ম রোধে স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করতেই হবে। পাশাপাশি কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়লে এর প্রতিবিধান নিশ্চিত করতে হবে সব ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে।