দেশের অর্থনীতি এখন ব্যাপক সংকটের মধ্যে রয়েছে। বর্তমান সরকারকে এ সংকট কাটিয়ে উঠতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে দেশের ব্যাংকিং খাতের নানা অনিয়মকারী ও পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর (১) নূরুন নাহারের হাতে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ ১৪ বিভাগের দায়িত্ব। তিনি দাপট খাটিয়ে এখন ‘মহাজনের’ ভূমিকা পালন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
মহাজন শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ থেকে। যার অর্থ মহৎ ব্যক্তি, বণিক ও বড় ব্যাপারী। কিন্তু অর্থনীতিতে ‘মহাজন’ শব্দটি ঋণদাতা অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার ‘মহাজন’ শব্দের অর্থে ভিন্নতা এনেছেন, তার কাছে এর অর্থ সৎ কর্মকর্তাদের মধ্যে ভয়-ভীতি ও দাপট প্রদর্শন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সকল পর্যায়ে তিনি হস্তক্ষেপ করেন। যার প্রভাব পড়েছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের নির্বাচনে। ব্যাপক সমালোচিত এ নির্বাচনে আওয়ামীপন্থি প্যানেলের প্রতি মৌনসম্মতি ছিলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর-১ নূরুন নাহারের। তার অনৈতিক হস্তক্ষেপে ‘দিনের ভোটে’ আওয়ামী পন্থীরা নিরঙ্কুশ জয় লাভ করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বদলিসহ অন্যান্য সুবিধাগুলো নিশ্চিত করা হয় মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগের মাধ্যমে। এই বিভাগের দায়িত্বেও রয়েছে নূরুন নাহার। এজন্য তার মৌন সম্মতি ভোটে বড় ধরণের প্রভাব সৃষ্টি করেছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কিছু কর্মকর্তা।
গত ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে অপসারণ করা হয়েছিলো। কিন্তু বিগত সরকারের নিয়োগ দেয়া কয়েকজন কর্মকর্তা এখনো ব্যাংক সংস্কারের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এর মধ্যে একই আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১৪টি বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন ডেপুটি গভর্নর (১) নূরুন নাহার।
জানা গেছে, ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পূর্বে ডেপুটি গভর্নর-২ ছিলেন নূরুন নাহার সাবেক ডেপুটি গভর্নর-১ কাজী ছাইদুর রহমানের স্থালাভিষিক্ত হন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেশাদার কর্মকর্তারা বিগত পনেরো বছর নানা প্রতিবন্ধকতায় স্বাধীনভাবে কাজ করতে পরেননি। তারা এখনো ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না। কারণ এখন মানব সম্পদ বিভাগসহ গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ বিভাগ এখন নূরুন নাহারের অধীনে।
কর্মকর্তারা অভিযোগ করে বলছেন, নূরুন নাহার ডেপুটি গভর্নর-১ হওয়া ব্যাংক সংস্কারে কোনো প্রকার মন্তব্য বা পরামর্শ দিতেও ভয় পাচ্ছেন কর্মকর্তারা। ব্যাংকের অভ্যান্তরে নূরুন নাহার একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এটি এতটাই শক্তিশালী যে তাদের বিরুদ্ধে কথা বললেই বদলি আতঙ্কে থাকেন ব্যাংকাররা। এনিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে। আওয়ামী সরকারের আমলে যারা ব্যাংক খাতে লুটপাট চালিয়েছে তাদেরকে স্বস্তি দিচ্ছেস ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার। অন্যদিকে অস্বস্তিতে পড়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তারা।
গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই ডেপুটি গভর্নর ও আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছেন। তবে ওই সময় ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার ও হাবিবুর রহমানকে পদে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
নির্দেশনা অনুযায়ী, ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান ও মো. খুরশীদ আলম পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাসও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপদেষ্টা আবু ফরাহ মো. নাছের পদত্যাগপত্র দিয়েছিলেন গভর্নর বরাবর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে, পুরো চাকরি জীবনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ কোন বিভাগে দায়িত্ব পালন না করেও অভিনব কায়দায় ডেপুটি গভর্নরের পদে আসেন নূরুন নাহার।
২০২২ সালের ১১ ডিসেম্বর থেকে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের (বিআরপিডি) দায়িত্ব পান নূরুন নাহার। ডেপুটি গভর্নর পদে আসার পরও এখন পর্যন্ত এই বিভাগ তার অধীনে রয়েছে। ব্যাংক খাতের সকল বিধি-বিধান এই বিভাগ থেকে প্রণয়ন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন হয়। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠীগুলোকে ব্যাংক দখল থেকে শুরু করে ঋণের নামে অর্থ লুটপাটের ও ঋণ পুনঃতফসিলের নামে অর্থ ফেরত না দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বিআরপিডি। এই বিভাগের শীর্ষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে এসবের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই নূরুন নাহারের সামনে, এমন বক্তব্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তার।
সাম্প্রতিককালে ডলার-টাকা বিনিময় হারের পুনঃনির্ধারণের সুযোগ নিয়ে কমিশনের বিনিময়ে প্রায় ৫৫ কোটি টাকা ক্ষতিতে ইসলামী ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রয় করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই লেনদেন সম্পাদনের সময় ফরেক্স রিজার্ভ এন্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্টের (এফআরটিএমডি) দায়িত্বে ছিলেন ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার।
এছাড়া শেখ হাসিনার সরকার পতনের চার দিন আগে বিশেষ সুবিধায় ন্যাশনাল ব্যাংকে বসুন্ধরা গ্রুপের ২৩’শ কোটি টাকা ঋণ মওকুফের ঘটনায় হাবিবুর রহমানের ও নূরুন নাহারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘কোন প্রকার যোগ্যতা যাচাই ছাড়াই সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের নির্দেশে নিয়োগ পান নূরুন নাহার। সাধারণত তিন-চার জনের নাম প্রস্তাব করে সার্চ কমিটি। সেখান থেকে একজনকে নিয়োগের সুপারিশ করেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু নজিরবিহীনভাবে নূরুন নাহারের বেলায় একক নাম প্রস্তাব করা হয়েছিলো। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তিনি বর্তমানে ডেপুটি গভর্নর-১ হওয়ার সুবাদে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে। তারা কয়েকবার বিক্ষোভ করেছে। গভর্নর বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে। যেকোন মুহূর্তে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে।
নাম প্রকাশ না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, দেশের সকল খাতে আওয়ামী পন্থীরা কোণঠাসা হয়ে পড়লেও বাংলাদেশ ব্যাংকে ভিন্ন চিত্র। বিগত দুই গভর্নর ফজলে কবির এবং আব্দুর রউফ তালুকদারের সাজিয়ে যাওয়া ছকেই চলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কোন অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নেয়নি বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন দশা হলে চলমান সংস্কার কিভাবে সফল হবে এমন প্রশ্ন রাখেন সংশ্লিষ্টরা।