[ অনলাইন ] 29/06/2025 |
 |
|
|
এনসিটি চালাবে বন্দর-নেভি
|
|
|
চট্টগ্রাম বন্দরের বহুল আলোচিত এনসিটি পরিচালনায় দুবাইভিত্তিক বিদেশি কোম্পানি ‘ডিপি ওয়ার্ল্ড’কে কোনো ইজারা দেয়া হচ্ছে না। আগের অপারেটরের মেয়াদও আর বাড়বে না। বন্দরের ‘হৃৎপিন্ড’ খ্যাত প্রধান কন্টেইনার স্থাপনা নিউমুরিং টার্মিনাল (এনসিটি) চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে রেখেই বন্দরের সহযোগিতায় পরিচালনা করবে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। বন্দরের মুনাফায় নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত ও ভারী যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং লাভজনক এনসিটি বন্দর-নেভি যৌথভাবে অপারেট করবে।
দেশের প্রধান চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর বিশেষত এনসিটির অবস্থানের সাথে স্পর্শকাতর ভূ-কৌশলগত ও নিরাপত্তার বিষয়াদি জড়িত থাকার পরিপ্রেক্ষিতে ডিপি ওয়ার্ল্ড অথবা বিদেশি অন্যকোনো কোম্পানিকে এনসিটির অপারেটর নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে। ফ্যাসিস্ট পলাতক হাসিনার আমলে বন্দরের এনসিটি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ইজারা প্রদানের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আর, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সেই সিদ্ধান্ত বাস্তাবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করতেই সচেতন নাগরিক মহল তীব্র প্রতিবাদ ও আন্দোলন শুরু করে। এদিকে গতকাল শনিবার নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ এবং প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকীকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শন করেন।
তারা বন্দর ভবনে বন্দর-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন। এ সময় নিউমুরিং টার্মিনাল (এনসিটি) নিয়েই মূলত আলোচনা হয়। বিদেশি কোনো অপারেটরের হাতে এনসিটি ছেড়ে দেয়ার পরিবর্তে কিংবা বিকল্প হিসেবে এনসিটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে রেখেই এবং বন্দরের সহায়তায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর মাধ্যমে পরিচালনার বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এনসিটি বন্দর কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে নৌবাহিনীর পরিচালনা পদ্ধতি সম্পর্কে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। জানা গেছে, বন্দর-নেভির যৌথ ও সমন্বিত উদ্যোগে এনসিটি পরিচালনার জন্য আশু প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি-প্রক্রিয়ার কাজগুলো দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিতে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা।
তিনি এ ক্ষেত্রে বন্দরের এ মুহূর্তে করণীয় সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেন। এর আগে গত ১৮ জুন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের সভায় চট্টগ্রাম বন্দরের দায়িত্বে রেখেই এনসিটি পরিচালনার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন এরজন্য বন্দর কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় গাইডলাইন প্রদান করেন। আগামী ৬ জুলাই এনসিটির পূর্ববর্তী অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের বর্ধিত চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। আগামী ৭ জুলাই থেকে এনসিটি সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের হাতে আসছে। তবে এর জন্য প্রয়োজণীয় দক্ষ অভিজ্ঞ অপারেটর-জনবল আপাতত বন্দরের কাছে নেই। নৌবাহিনীর সাথে বন্দরের সমন্বিত প্রচেষ্টায় তা পরিপূরণ হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে গতকাল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) সচিব ও মুখপাত্র মো. ওমর ফারুকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ইনকিলাবকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সহায়তায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী বন্দরের এনসিটি পরিচালনার বিষয়ে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি সিদ্ধান্ত আসেনি। আশা কারছি দুয়েকদিনের মধ্যেই নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে এবং তখন আপনারাও জানতে পারবেন। গতকালের বন্দর ভবনে বৈঠকটি রুদ্ধদ্বার ছিল বলে জানান তিনি।
এদিকে দেশের রাজনৈতিক দল, জোট, শ্রমিক-কর্মচারী জোট-সংগঠন, বন্দর-শিপিং সার্কেল, অর্থনীতি ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মহলের পক্ষ থেকে বিদেশি কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে এনসিটি কিংবা চট্টগ্রাম বন্দরের কোনো স্থাপনা ইজারা প্রদানের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ, ক্ষোভ-অসন্তোষ ও তীব্র হয়ে ওঠা আন্দোলনের মধ্যেই গতকাল দুই উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূতের চট্টগ্রাম বন্দরে পরিদর্শন এবং সভার মধ্যদিয়ে এনসিটির পরিচালনার বিষয়টি কেন্দ্র করে অবশেষে সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করলো। এর মধ্যদিয়ে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ঘিরে সৃষ্ট বিতর্ক ও প্রতিবাদের সমাধান বেরিয়ে আসবে আশা করা হচ্ছে। বিগত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট ভারতে পলাতক হাসিনার সরকার জনগণকে অন্ধকারে রেখেই ২০২৩ সালে বন্দরের এনসিটি পরিচালনায় ডিপি ওয়ার্ল্ড কোম্পানির সাথে চুক্তির প্রক্রিয়া শুরু এবং ২০২৪ সালের মার্চ মাসে তার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। হাসিনার পতনের সাথেই তা থেমে যায়। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এসে আগেই সেই ফ্যাসিস্ট আমলের একই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগকে কেন্দ্র করে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় সচেতন সর্বস্তরের নাগরিকমহল।
‘দেশের নিরাপত্তা ও স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ রুখে দাঁড়াবো’ ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দেশপ্রেমিক জনগণ’ এই ব্যানারে বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতৃত্বে প্রায় ৫০টি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-সংগঠনের অংশগ্রহণে গত শুক্রবার সকালে রাজধানী ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে শুরু হওয়া ‘বন্দর বাঁচাতে, করিডোর ঠেকাতে’ দু’দিনব্যাপী রোডমার্চ গতকাল শনিবার বিকাল ৫টায় চট্টগ্রাম বন্দর ভবনের সামনে সমাবেশের মধ্যদিয়ে শেষ হয়। সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি অথবা কোনো স্থাপনায় বিদেশি ডিপি ওয়ার্ল্ড কিংকা অন্যকোনো কোম্পানিকে ইজারায় ছেড়ে দিলে তা দেশের স্বার্থবিরোধী এবং নিরাপত্তার প্রতি মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করবে। তাছাড়া রাখাইনে তথাকথিত মানবিক করিডোর বা চ্যানেল প্রদানের কারণে দেশের সার্বভৌমত্ব, নিারাপত্তায় হুমকির কারণ হতে পারে। ডিপি ওয়ার্ল্ডকে বন্দরে ইজারা প্রদানে পলাতক ফ্যাসিস্ট হাসিনার সেই সিদ্ধান্ত কেন অন্তবর্তী সরকার বাস্তবায়ন করবে? সমগ্র দেশের জনগণ সা¤্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী অপশক্তির যে কোনো চক্রান্ত অতীতের মতোই একযোগে রুখে দাঁড়াবে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে কোনো আধিপত্যবাদী অপশক্তির ঘাঁটি গাঁড়তে দেয়া হবে না।
বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে না দেয়া, মানবিক করিডোর না দেয়া, বাংলাদেশে বিদেশীদের সমরাস্ত্র কারখানা স্থাপনের অনুমতি না দেয়া এবং স্টারলিংকের সাথে চুক্তি বাতিলের দাবিতে উক্ত রোডমার্চ শেষে সমাপনী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে রোডমার্চ ফেনী, বারৈয়ারহাট, সীতাকুন্ডে সমাবেশ শেষে করে মিছিল সহকারে চট্টগ্রাম নগরীতে পৌঁছায়। বারিক বিল্ডিং থেকে পদযাত্রা করে বিকাল ৫ টায় বন্দর ভবন চত্বরে পৌঁছায়।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ, ফ্যাসিবাদ বিরোধী বাম মোর্চার সমন্বয়ক ও গণমুক্তি ইউনিয়নের সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন আহম্মদ নাসু, সাম্যবাদী আন্দোলনের আহ্বায়ক শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাসদের (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মাসুদ রানা, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক হারুনার রশিদ ভূঁইয়া, জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চের সমন্বয়ক মাসুদ খান, বাংলাদেশের জাসদ নেতা ডা. মুশতাক হোসেন প্রমুখ। সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করেন শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ(স্কপ) চট্টগ্রাম নেতৃবৃন্দ।
নেতৃবৃন্দ বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান তিনটি কাজ ছিল জুলাই হত্যাকান্ডের বিচার,গণতান্ত্রিক সংস্কার ও নির্বাচন আয়োজন। অথচ এসব কাজের দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কোন আলোচনা ছাড়াই বন্দরের টার্মিনাল বিদেশিদের লিজ দেয়া ও মানবিক করিডোরের মতো এখতিয়ার বহির্ভূত সিদ্ধান্ত সরকার নিচ্ছে। আমরা সরকারকে এ ধরণের তৎপরতা থেকে সরে আসার আহবান জানাই। তারা নিউমুরিং টার্মিনাল বিদেশিদের কিংবা বেসরকারীকরণ না করেই চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়িয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার দাবি জানান।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, বাংলাদেশের আমদানি রপ্তানির ৯২ ভাগ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই হয়। অর্থাৎ দেশের অর্থনীতি প্রধানত চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নিভর্রশীল। বন্দরের মত কৌশলগত সম্পদ নিয়ে যেকোন সিদ্ধান্ত শুধু অর্থনৈতিক লাভ দিয়ে বিচার করা যায়ন; দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক-সামরিক, নিরাপত্তায় ঝুঁকি ইত্যাদি অনেক স্পর্শকাতর বিষয় এর সাথে যুক্ত। যেখানে দেশের একটি প্রধান বন্দর এবং এর বাইরে অগুরুত্বপূর্ণ বন্দর আছে, সেখানে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে এর কোনো অংশ লিজ দেওয়া আরও ঝুঁকিপূর্ণ। নেতৃবৃন্দ করিডোর নিয়ে সরকারের অস্পষ্ট অবস্থানের সমালোচনা করে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ চক্রান্তে বাংলাদেশকে না জড়ানোর দাবি জানিয়ে বলেন, দেশের স্বার্থবিরোধী এসব তৎপরতা বন্ধ না হলে দেশবাসীকে সাথে নিয়ে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। |
|