[ অনলাইন ] 29/06/2025
 
উচ্চ সুদহার, খেলাপি ঋণ বিনিয়োগে প্রভাব ফেলছে
উচ্চ সুদহারের পাশাপাশি ব্যাংক খাতে উচ্চ খেলাপি ঋণ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। তবে এর মধ্যে বর্তমানে টাকা-ডলার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা ব্যবসায়ীদের কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে। গতকাল শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘ব্যাংক খাতের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ: ঋণ গ্রহীতার প্রেক্ষিত’ শীর্ষক সেমিনারে ব্যবসায়ীদের বক্তব্যে এমন মত উঠে আসে। ব্যাংক খাত নিয়ে আলোচনায় গ্যাস সংকটসহ ব্যবসায়ীদের অন্য সমস্যাও তুলে ধরেন বক্তারা। 

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, আইসিইউ থেকে দেশের অর্থনীতি টেনে তুলেছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। তিনি মনে করেন, সুদহার ছাড়াও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের নানা পন্থা রয়েছে। তবে চীন ছাড়া সারা বিশ্ব এ নীতি থেকে বের হতে পারছে না। বর্তমান অবস্থায় ভালো ব্যাংক কেন উচ্চ সুদে ঋণ দিচ্ছে, সেই প্রশ্ন রাখেন তিনি। এ ছাড়া ঋণদাতা ও গ্রহীতা উভয়কেই দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ দেন। 

আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ১৫ বছরে দেশের দুর্নীতির অবস্থা জেনেও আইএমএফ ঋণ দিয়েছে। এর দায় কি আইএমএফের নেই? চুরি হচ্ছে জেনে এডিবি-বিশ্বব্যাংক ঋণ দিয়েছে। তাদেরও কী দায় নেই? জুলাই বিপ্লবের আগে বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যাবে, তারা বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতি নিয়ে প্রশংসায় ভাসিয়ে ফেলেছে। এখন আবার তারা (বিশ্বব্যাংক) নানা রকম উপদেশ দিচ্ছে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. এজাজুল ইসলাম বলেন, উচ্চ সুদের কারণে ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলা হচ্ছে। অথচ ব্যবসায়ীদের দাবি শুনে গত সরকার সুদহার বেঁধে দিয়ে ঋণে ৯ শতাংশ এবং আমানতে ৬ শতাংশ করেছিল। এই নয়-ছয় উচ্চ মূল্যস্ফীতির বীজ বপন করে। বিনিয়োগ আনা যায়নি, মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি। মাঝখান থেকে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ ক্ষয় হয়েছে। 

তিনি বলেন, জুলাইয়ের পর বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা করা হয়েছে। রিজার্ভ বেড়ে ৩০ বিলিয়নের ওপরে উঠেছে। এ কারণে ব্যবসায়ীরা আস্থা পাচ্ছেন। সুদহার নির্ধারণে এখন ব্যাংকগুলোর স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। ভালো ব্যাংক চাইলে কম সুদে ঋণ দিতে পারে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিরোধিতার পরও বিগত সময়ে কিছু নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স চাপিয়ে দেওয়া হয়। একটা গ্রুপের হাতে অনেক ব্যাংক তুলে দেওয়া হয়। ফলে এ খাতে অস্বচ্ছতা ও অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়।

ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, কিছু মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে চলে গেছে। সেই দায় সবাই নেবে না। বিদেশি ব্যাংক এখন অর্ধেকের বেশি ব্যাংকের এলসি নিচ্ছে না। ব্যাংক খাতের ২৪ শতাংশের বেশি ঋণ এখন খেলাপি। স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগে এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশে নেমেছে, কর্মসংস্থানের ওপর যা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালা কঠিন করার ক্ষেত্রে আরও সময় দাবি করেন তিনি। 

মূল প্রবন্ধে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ডলারের দর ৮৫ টাকা থেকে ১২২ টাকা হওয়ায় বিনিময় হারজনিত লোকসান হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। আবার ৯ শতাংশ সুদহার এখন ১৪ শতাংশ হওয়ায় বাড়তি সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যবসায় খরচ বেড়েছে ৪০ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করলে বিক্রি কমেছে ৩০ শতাংশ। অল্প কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণের কারণে পুরো খাতের খেলাপি অনেক বেড়েছে। 

ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যান আব্দুল হাই সরকার বলেন, ব্যাংক খাতে এত খেলাপি ঋণ অথচ অর্থঋণ আদালত মাত্র চার থেকে পাঁচটা। এর মধ্যে বিচারকরা অসুস্থ থাকেন। শুনানি পিছিয়ে যায়। অর্থঋণ আদালতের সমস্যার সমাধান করা গেলে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ খেলাপি ঋণ ঠিক হয়ে যাবে।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও আনোয়ার গ্রুপের এমডি হোসেন খালেদ বলেন, খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে, যা অব্যাহত থাকলে আগামীতে কারখানা চালুর রাখাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে আসবে। 

 র‍্যাংগস মোটরসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহানা রউফ চৌধুরী বলেন, ব্যবসায়ীদের সমস্যার শেষ নেই। উৎপাদন খাতে এত বেশি সুদহার দিয়ে টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি স্থানীয়ভাবে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনে স্বল্প সুদের তহবিল গঠনের সুপারিশ করেন। 

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এমডি মতিউল হাসান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারি-বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন তিনি।