[ অনলাইন ] 04/07/2025 |
 |
|
|
সংকটে পড়া ইসলামী ব্যাংকগুলোকে একীভূত করতে কী কী প্রয়োজন হবে?
|
|
|
জেবুন নেসা আলো
আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে সরকার প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা মূলধন সরবরাহ করবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের পাঁচটি সংকটে পড়া ইসলামী ব্যাংকের সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই বিপুল ঘাটতি পূরণে মূলধন জোগান না দিলে পরিকল্পিত একীভূকরণ কার্যকর করা সম্ভব নয়। ব্যাপক ঋণখেলাপি এবং আমানতকারীদের অর্থ উত্তোলনের কারণে এসব ব্যাংকের সম্পদ ও দায়ের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হয়েছে।
এই সংকট মোকাবিলায় আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে সরকার প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা মূলধন সরবরাহ করবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। অবশিষ্ট অর্থ সংগ্রহ করা হবে স্পন্সর পরিচালকদের কাছ থেকে জব্দ করা শেয়ার—নতুন কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে। যেসব শেয়ার বিক্রি করা সম্ভব হবে না, সেগুলো স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের কাছে ছেড়ে দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, এই পাঁচ ব্যাংকের বড় ধরনের মূলধন ঘাটতির কারণেই একীভূকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, "এত বড় মূলধন ঘাটতি নিয়ে এসব ব্যাংক চলতে পারে না। আমরা ইতোমধ্যে সরকারকে অনুরোধ করেছি, তারা যেন ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা মূলধন হিসেবে সরবরাহ করে।"
প্রস্তাবিত একীভূতকরণের আওতায় থাকা পাঁচটি ব্যাংক হলো: এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠানে মোট ১৮ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে।
নিম্নস্তরের কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তা, তবে টপ ম্যানেজমেন্ট নিশ্চিত থাকতে পারবেন না
কর্মীদের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানান, নিচের পর্যায়ের কর্মীদের চাকরি সুরক্ষিত থাকবে, তবে শীর্ষ ব্যবস্থাপক পর্যায়ে কেউই নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন না।
তিনি আরও জানান, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই এই একীভূকরণ চূড়ান্ত রূপ পাবে। তবে এই সময়ের মধ্যে আমানতকারীরা তাদের নিজ নিজ ব্যাংকে লেনদেন স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে যেতে পারবেন।
এস আলম গ্রুপের প্রভাব ও ভয়াবহ খেলাপির চিত্র
একীভূকরণের আওতায় থাকা পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে চারটি—এসআইবিএল, ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউনিয়ন এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক—পূর্বে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে এসব ব্যাংকের স্পন্সর পরিচালকদের মালিকানাধীন শেয়ার জব্দ করেছে, যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এস আলম গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
পাঁচ ব্যাংকের সম্পদের মান নিয়ে এক্সটার্নাল অডিটরদের পর্যালোচনায় ভয়াবহ খেলাপির হার উঠে এসেছে। দেখা গেছে, এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২৮ শতাংশ, এসআইবিএলের ৬০ শতাংশ; অন্যদিকে ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউনিয়ন এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক প্রত্যেকের খেলাপি ঋণের হার ৯৫ শতাংশ। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে জানানো হয়েছে, এই পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত সম্পদ-দায় ফারাক দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা।
অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও আমানত-সম্পদ ব্যবধান
পরিস্থিতি ভয়াবহ হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে একীভূকরণের ঘোষণা দেয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর কেবল বিভিন্ন ফোরামে এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানিয়েছে, এক্সিম ব্যাংক এবং এসআইবিএল নাকি একীভূকরণের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। যা পরিস্থিতির জটিলতাকে আরও বাড়িয়েছে।
মূলধন ঘাটতি ও ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বিতরণ
ব্যাংকগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখেছে টিবিএস, যাতে পৃথকভাবে উঠে এসেছে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মূলধন ঘাটতির চিত্র: এক্সিম ব্যাংকে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা, এসআইবিএলে ৬ হাজার কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ১৬ হাজার কোটি টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ২ হাজার কোটি টাকা এবং ইউনিয়ন ব্যাংকে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসব ব্যাংকে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। বিপরীতে, এসব ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ১ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা, ফলে প্রায় ৫৫ হাজার ৫৯১ কোটি টাকার আমানত-সম্পদ ব্যবধান তৈরি হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত ৯২ শতাংশ অগ্রিম-আমানত হারের (এডিআর) ব্যাপকভাবে পেরিয়ে গিয়ে এই ব্যবধান নিয়মভঙ্গ করেছে, ফলে আমানতকারীদের টাকা চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
সম্পদ মান পর্যালোচনার প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব ব্যাংকের মোট ঋণের ৭০ শতাংশ ইতোমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে। এই পাঁচ ব্যাংকে মোট ১৭ হাজার ৭৮৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত আছেন, এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের ১,১৮৯টি শাখা ও উপশাখা পরিচালিত হচ্ছে।
একীভূকরণের যৌক্তিকতা ও প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন
এই একীভূকরণের সিদ্ধান্ত অর্থনীতিবিদদের মাঝে প্রশ্ন তুলেছে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে, কেন এই নির্দিষ্ট ব্যাংকগুলোকে একীভূকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।
তিনি বলেন, "বিদ্যমান আইন অনুসারে, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সংকটে থাকা প্রতিটি ব্যাংকের কাছে তাদের নিজস্ব সমাধান পরিকল্পনা (রেজল্যুশন প্ল্যান) চাইতে হবে। সেসব পরিকল্পনা অকার্যকর হলে, তবেই একীভূকরণ বা অবসায়ন বিবেচনা করা যেতে পারে।"
"যেমন এক্সিম ব্যাংক ও এসআইবিএলের অবস্থা অন্য তিনটির মতো এতটা সংকটাপন্ন নয়, তাঁরা একীভূত হতে রাজী নয় বলেও শোনা যাচ্ছে। তাদের কি একীভূকরণের আগে নিজস্ব রেজল্যুশন প্ল্যান জমা দিতে বলা হয়েছে?" – প্রশ্ন রাখেন তিনি।
জাহিদ হোসেন সতর্ক করেন, আইনে জোরপূর্বক একীভূকরণের সুযোগ থাকলেও—সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। পাশাপাশি শেয়ার বিক্রির সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে, যাতে সরকারি অর্থ অপচয় না হয়। সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত ব্যাংকগুলো নিয়ে কোনো আশা না থাকলে— অবসায়ন কেন বিবেচনা করা হচ্ছে না, সে প্রশ্নও তোলেন তিনি।
কর্মীদের চাকরি ও আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তা নিয়ে গভর্নরের আশ্বাস বাস্তবসম্মত নয় বলেও মনে করছেন ড. জাহিদ। কারণ, একীভূকরণের পরও আগের মতো একই সংখ্যক শাখা ও কর্মী রাখা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।
এদিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, বাংলাদেশে অতিরিক্ত ব্যাংকের সংখ্যা এবং একীভূকরণের আওতায় থাকা ব্যাংকগুলোর ভয়াবহ অবস্থার কারণে এই পদক্ষেপ যৌক্তিক। তবে তিনি সতর্ক করেন, একীভূকরণের পর নতুন প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি বাস্তবসম্মত মডেল তৈরি করতে হবে। কারণ, বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ এবং প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ বজায় রাখতে তখনও সরকারের আর্থিক সহায়তার দরকার হতে পারে।
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পদ বিক্রি এবং একীভূকরণ মডেল নিয়ে কাজ করছে, যাতে নতুন সত্ত্বার টেকসইতা নিশ্চিত করা যায়।
'ব্রিজ ব্যাংক' মডেল হতে পারে সমাধান
২০২৫ সালের ব্যাংক রেজল্যুশন অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী সংকটে পড়া ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। এই অধ্যাদেশের আওতায়, সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে এসব ব্যাংককে সাময়িকভাবে সরকারি মালিকানায় আনতে পারবে এবং ব্যাংক রিস্ট্রাকচারিং ও রেজল্যুশন ফান্ড থেকে আর্থিক সহায়তা দিতে পারবে।
সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর সংকট নিরসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে 'ব্রিজ ব্যাংক' গঠন করতে পারবে, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে এগুলো তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করা। ব্রিজ ব্যাংক মূল ব্যাংকের সম্পদ, দায়, আইনি অধিকার এবং বাধ্যবাধকতা আংশিক বা পুরোপুরি গ্রহণ করবে।
সঞ্চয়ী আমানতের সুদের হার ম্যাচিউর হওয়ার আগ পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকবে, তবে ব্রিজ ব্যাংক অন্যান্য আমানতের সুদের হার পরিবর্তন করতে পারবে। ব্রিজ ব্যাংক গঠনের পর মূল সংকটাপন্ন ব্যাংকের লাইসেন্স বাতিল করা হবে, এবং অবশিষ্ট সম্পদ ও দায়সমূহ অবসায়নের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে।
ব্রিজ ব্যাংকের পরিচালনা ও মেয়াদ
ব্রিজ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও শীর্ষ ব্যবস্থাপনায় থাকতে হবে "যোগ্য ও উপযুক্ত" ব্যক্তি, যাদের নিয়োগ দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। সাধারণত ব্রিজ ব্যাংকের মেয়াদ দুই বছর, তবে প্রয়োজনে এক বছর করে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যাবে।
ব্রিজ ব্যাংকের লক্ষ্য পূরণ হলে বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে এই ব্যাংককে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত করতে পারবে, সম্পূর্ণ বা আংশিক বিক্রি করতে পারবে অথবা লিকুইডেশন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে। |
|