[ অনলাইন ] 12/07/2025 |
 |
|
|
বারকাতের সময়েই লুটপাট শুরু
|
|
|
জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতকে দুদকের মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। শুক্রবার বিকালে শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল রানা এ আদেশ দেন। এদিন দুপুর ২টা ২২ মিনিটের দিকে ড. বারকাতকে সিএমএম আদালতের হাজতখানায় হাজির করা হয়। এরপর দুপুর ২টা ৪৯ মিনিটের দিকে আদালতের এজলাসে তোলা হয় ড. বারকাতকে। দুদকের মামলায় তার বিরুদ্ধে অ্যাননটেক্স গ্রুপকে বেআইনিভাবে ঋণ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া তার সময়ে জনতা ব্যাংকে বড় ধরনের লুটপাটের ঘটনা শুরু হয়। তিনি এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেননি। উলটো রাজনৈতিক চাপের কারণে ছিলেন নির্বিকার। পরবর্তী সময়ে যারা চেয়ারম্যান বা এমডি হিসাবে এসেছেন, তারাও রাজনৈতিক চাপে ব্যাংকটিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছেন।
বর্তমানে ব্যাংকটির বিতরণ করা মোট ঋণের মধ্যে খেলাপি প্রায় ৭৫ শতাংশ। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশই আদায় অযোগ্য ঋণে পরিণত হয়েছে। তারল্য সংকট প্রকট। লাভের পরিবর্তে এখন লোকসান হচ্ছে। অদক্ষ পর্ষদ ও দুর্নীতিবাজ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কারণে সরকারি খাতের ব্যাংকটি আজ অতি দুর্বলতার তালিকায় চলে গেছে।
জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে আলোচিত অ্যাননটেক্স গ্রুপকে দেওয়া ২৯৭ কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দুদকের মামলায় আবুল বারকাতকে গ্রেফতার করা হয়।
ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগপন্থি এই অর্থনীতিবিদ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন হিসাবে সবার কাছে বেশ পরিচিত ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ম্যানিফেস্টো তৈরিরও অন্যতম রূপকার।
সূত্র জানায়, প্রচলিত বিধি অনুযায়ী অ্যাননটেক্স গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে এক দফা ঋণ পেয়ে দ্বিতীয় দফায় আর ঋণ পাচ্ছিল না। কারণ, তিনি ঋণ নিয়ে তা যথাযথভাবে ব্যবহার করেননি। ফলে পরবর্তী সময়ে বিধিবিধান অনুযায়ী তিনি ঋণ পাওয়ার যোগ্য ছিলেন না। তখন অ্যাননটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইউনুস (বাদল) জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আবুল বারকাতের সঙ্গে দেখা করে তাকে ঋণ দেওয়ার দাবি করেন। তিনি ভালোভাবে ব্যবসা করে আগের ঋণসহ নতুন নেওয়া ঋণ পরিশোধের অঙ্গীকার করেন। এতে প্রভাবিত হয়ে আবুল বারকাত তাকে ঋণ দিতে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু শর্ত দিয়েছিলেন ঋণের প্রস্তাব শাখা থেকে বিধিসম্মতভাবে আসতে হবে।
কিন্তু অ্যাননটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইউনুস (বাদল) ড. বারকাতের কথায় আস্বস্ত না হয়ে তিনি যোগাযোগ করেন ব্যাংকের তৎকালীন সিবিএ নেতা ও ব্যাংকের করণিক রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনিই বাদলকে নিয়ে ব্যাংকের এমডি ও চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিলেন। কারণ, সিবিএ নেতা ও শ্রমিক লীগের নেতা হিসাবে রফিকুল ইসলামের ছিল ব্যাংকে ব্যাপক দাপট। তিনি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকে যে কোনো বেআইনি কাজ করতে পারতেন। তিনি তা করেছেন। এসব করে তিনি সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
ইউনুস বাদল আগে ছিলেন একজন পরিবহণ শ্রমিকনেতা। এ সূত্রে রফিকুল ইসলামের সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল। পরিবহণ শ্রমিকনেতা থেকে তিনি ব্যবসায় আসেন। সে ব্যবসায় প্রথমে ভালো করছিলেন না। পরে রফিকুল ইসলামের হাত ধরে ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নেন। অ্যাননটেক্স গ্রুপ এখন পর্যন্ত জনতা ব্যাংক থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। সুদসহ ঋণের পরিমাণ বর্তমানে ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পুরো ঋণই এখন খেলাপি। এর মধ্যে মাত্র ২৯৭ কোটি টাকা ঋণের জালিয়াতির দায়ে মামলা হলো। তবে জনতা ব্যাংক অ্যাননটেক্সের বিরুদ্ধে ঋণ আদায়ের জন্য মামলা করেছে।
অ্যাননটেক্সে এত ঋণ নিতে সহায়তা করেছেন ব্যাংকের সাবেক এমডি, ডিএমডি, জিএমসহ শাখা ব্যবস্থাপক। এসব খাতে প্রভাব রাখতেন সিবিএ নেতা রফিকুল ইসলাম। ফলে নিচের দিক থেকে তার ঋণের প্রস্তাব পরিশুদ্ধভাবে পর্ষদে উপস্থাপন করা হতো। পর্ষদ তা কোনোরকম যাচাই-বাছাই না করেই অনুমোদন দিয়ে দিত। অথচ পর্ষদের দায়িত্ব ছিল ঋণ অনুমোদনের আগে খুঁটিনাটি বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করা। কিন্তু তা করা হয়নি। এ কারণে পর্ষদ অ্যাননটেক্সের ঋণের জালিয়াতির দায় এড়াতে পারে না। ব্যাংকের ডেস্ক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে শাখা ব্যবস্থাপক, জিএম, ডিএমডি, এমডি ও ক্রেডিট কমিটি অ্যাননটেক্সের বিষয়ে যে ভুল তথ্য দিয়ে পর্ষদে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছেন, এ কারণে তারাও এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত।
ড. আবুল বারকাত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসাবে নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি। যে কারণে ওই সময়ে রাজনৈতিক প্রভাবে অনেক জাল-জালিয়াতি হয়েছে। কিন্তু তিনি রাজনৈতিক চাপ মোকাবিলা করতে পারেননি। ওই সময়ে শুধু অ্যাননটেক্স জালিয়াতি হয়েছে তা নয়, ক্রিসেন্ট গ্রুপের বড় জালিয়াতি হয়েছে। ওই গ্রুপের কাছেও ব্যাংকের ঋণ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বড় অংশই খেলাপি। এক্ষেত্রেও সিবিএ নেতা রফিকুল ইসলাম ভূমিকা রেখেছেন। কারণ, তার নিজের চলচ্চিত্র ব্যবসার প্রতিষ্ঠান ঝিনুক কথাচিত্রের সঙ্গে মালিকানা রয়েছে। সে হিসাবে ক্রিসেন্ট গ্রুপের মালিকের ভাইয়ের প্রতিষ্ঠান জাজ করপোরেশনকে দেওয়া হয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপের টাকা। ফলে দুই পক্ষই চলচ্চিত্র ব্যবসায় টাকা বিনিয়োগ করে অন্যান্য বেআইনি কাজ কারবার করেছেন। দুই গ্রুপের কাছ থেকেই রফিকুল ইসলাম মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন। সে টাকায় তিনি টাঙ্গাইলে একটি বিশাল ও ব্যয়বহুল মসজিদ তৈরি করেছেন। মধুরিমা নামে একটি সিনেমা হলের মালিক ছিলেন তিনি। সেটি এখন বন্ধ। গুলিস্তান খদ্দর মার্কেটেও তার কয়েকটি দোকান রয়েছে। তিনি একসময় এই মার্কেটের মালিক সমিতির সভাপতিও ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে-একজন ব্যাংকের করণিক হিসাবে তিনি কীভাবে এসব সম্পদ অর্জন করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মূলত প্রভাব খাটিয়ে বেআইনি ঋণ পাইয়ে তার বিপরীতে কমিশন নিয়েই এসব সম্পদ অর্জন করেছেন।
জনতা ব্যাংকে ড. বারকাতের সময়ে আরও অনেক অনিয়ম হয়েছে। সেগুলো তিনি প্রতিরোধ করেননি। এর মধ্যে ব্যাংক রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক খেলাপি ঋণ নিয়েছে। কোনো ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই সেগুলো নবায়ন করে আবার নতুন ঋণ দিয়েছে। সেগুলোও এখন খেলাপি। এছাড়া বেক্সিমকো গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে রপ্তানি করে ডলার দেশে না এনে বিদেশে পাচার করেছে। কেবল বেক্সিমকো গ্রুপই জনতা ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। যেগুলোর মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকাই খেলাপি। এস আলম গ্রুপের কাছে খেলাপি ঋণ ১০ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে ওই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ড. আতিউর রহমান। তার সঙ্গে আবুল বারকাতের বেশ বিবাদ ছিল। যে কারণে আতিউর রহমান জনতা ব্যাংকের ওপর একাধিক পরিদর্শন করিয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলোয় অনিয়মের তথ্য ওঠে এলেও তৎকালীন গভর্নরও রাজনৈতিক চাপের কারণে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। উলটো সব ধরনের বেআইনি ঋণকে একের পর এক কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদন করে গেছে।
ড. আতিউরের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গর্ভনরের দায়িত্ব পান সাবেক অর্থ সচিব ফজলে কবির। তিনিও ব্যাংক খাতে সব অনিয়মের বিষয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। তিনি কোনো অনিয়ম যাতে উদ্ঘাটন না হয়, সেজন্য পরিদর্শনব্যবস্থাকে একেবারে অকেজো করে রাখেন। ফলে তিনিও কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। এরপর আবদুর রউফ তালুকদার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদে বসে আগের অনিয়মের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেননি। উলটো তিনি আরও জালিয়াতিকে উসকে দেন। |
|