[ অনলাইন ] 13/07/2025
 
সমবায় সমিতির শত কোটি টাকার সম্পত্তি আত্মসাৎ
এ যেন মগের মুল্লুক। ইচ্ছে করলেই বিক্রি করা যায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) লে-আউটভুক্ত রাস্তা, গ্রীনজোন, ইদগাঁ, স্কুলের মাঠ এমনকি খোদ মসজিদের জায়গাও। দেশের প্রচলিত আইনানুযায়ী বিক্রিত জমি হস্তান্তরে সাব কবলা দলিল লাগলেও এ মগের মুল্লুকে সম্পাদক স্বাক্ষরিত পাওয়ারই মালিকানার প্রমাণ। এক দেশে দুই আইন, কল্পনার নবাবী সাম্রাজ্য। ফলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবাসী পরিবারসহ অনেকেই এখন বাস্তুচ্যুত। আর এ সমিতির সকল অপকর্মের সহযোগী খোদ চট্টগ্রাম সমবায় অফিসের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। তারা টাকার বিনিময়ে বছর বছর অনিয়ম-দুর্নীতির ছাড়পত্র দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ মগের মুল্লুকের নাম চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বেস্তামী থানার চৌধুরীনগর আবাসিক এলাকা। আর অপকর্মের হোতা চৌধুরীনগর বহুমুখী সমবায় সমিতি লি:, রেজিস্ট্রেশন নং ৭২৯৮।

তথ্য প্রমাণে জানা যায়, ১৯৯০ সালে সাব কবলা দলিলে জমির মালিক স্থানীয় অধিবাসীরা এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে প্রতিষ্ঠা করেন এ সমিতি। পরবর্তীতে সমিতিও কিছু জায়গা ক্রয় করে ২৫ একর জায়গার উপর সিডিএ লে-আউট প্ল্যান পাশ করে। পরবর্তীতে সমিতির ক্রয়কৃত জায়গা দলিলমূলে নিজেদের দাবি করেন কতিপয় ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি জাতীয় গ্রিডের বিদুৎ লাইন ও পাহাড় রক্ষায় সরকারও উদ্যেগ নেয়। ফলশ্রুতিতে ১৯৯৮ সালে হাইকোর্ট উক্ত জায়গা ক্রয়-বিক্রয় ও হস্তান্তরে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

বার্ষিক অডিট রিপোর্টে জানা যায়, চৌধুরী নগর বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক মামলা নিস্পত্তি সংক্রান্ত ব্যয়ের অজুহাতে ভুয়া ভাউচারে ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। আর সমিতির দখলে থাকা জায়গার নামজারি খতিয়ান তৈরির জন্য অজ্ঞাত ভূমি কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়ার নামে ৭০ লাখ টাকা এবং ওয়াসার পানির লাইন সংযোগে অজ্ঞাত ইঞ্জিনিয়ারকে ঘুষ বাবদ সাড়ে ৩ লাখ টাকা পারস্পরিক যোগসাজসে আত্মসাত করে। কিন্তু এখনো ওয়াসার পানির লাইনের সংযোগ ও জমির নামজারি হয়নি।

এদিকে সমিতির সভাপতি শামসুল হুদা নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের গডফাদার হিসাবে পরিচিত। গত ১৫ বছর স্থানীয় পর্যায়ে অবৈধ ভূমি দখল, পাহাড়কাটা, বালু বিক্রি, কিশোর গ্যাং, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন তিনি। তার স্ত্রী মাহমুদা হুদা মহিলা আওয়ামী লীগ, ছেলে নাজমুল হুদা যুবলীগ, পুত্রবধূ তানজিয়া সুলতানা যুব মহিলা লীগ, কনিষ্ঠ সন্তান মইনুল হুদা নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অভিযোগ আছে, শামসুল হুদা দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে আবাসিকের পাশ্ববর্তী পাহাড় পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুব ও পাইপ ফ্যাক্টরি সমিতির সদস্য মোহাম্মদ কালামের কাছ থেকে দখল করে নেন। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার মামলাও হয়েছে। অবৈধভাবে পাহাড় কাটার অপরাধে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম শামসুল হুদাকে অর্থদণ্ড প্রদান করে। সমিতির অর্থ সম্পাদক মো. আবদুল হান্নান ছাত্র হত্যা মামলায় কারাগারে। আর সাবেক সম্পাদক হারুনুর রশিদ নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নগরীর ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ড নেতা। অভিযোগ রয়েছে, জুলাই গণআন্দোলনে নগর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার নির্দেশে বহদ্দারহাট ও নিউমার্কেটে ছাত্র-জনতার উপর হামলাকারীদের আর্থিকভাবে পৃষ্টপোষাকতা করেন এই হারুনুর রশীদ। ৫ আগস্ট হারুনুর রশীদ ও তার ছেলে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা অনয় এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন চৌধুরী জানান, ‘সদস্যদের ওই টাকা সভাপতির সম্মতিতে ভাউচার দিয়ে নিয়েছি। এ টাকা সমিতির পক্ষ থেকে খরচ করা হয়েছে, এটা আমার একার কোনো বিষয় নয়।’

সমিতির সভাপতি শামসুল হুদার মোবাইল ফোনে কল দিলে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর তিনি নিজের নাম মহসিন উল্লেখ করে কথা বলতে অস্বীকার করেন। এরপরও এ প্রতিবেদক অভিযোগসমূহ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যা ইচ্ছা লিখে যান। আমরা (আওয়ামী লীগ) আবার ক্ষমতায় আসলে কড়ায়-গন্ডায় উসুল করব।’

দৈনিক বাংলার অনুসন্ধানে জানা যায়, সমিতির সব অপকর্মে প্রশাসনিকভাবে সহায়তা করেছে পাঁচলাইশ থানা সমবায় অফিসার (বর্তমানে পটিয়া উপজেলা অফিসার) মো. শফিউল আলম ও জেলা সমবায় অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তার সঙ্গে সমিতির সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল হুদা ব্যক্তিগত সম্পর্ক সর্বজনবিদিত। সমিতির সকল অপকর্ম সহায়তার পুরস্কার হিসাবে সমিতির সভাপতি হুদা সমবায় অফিসার শফিউলকে কখনো ক্যাশ কখনো বিকাশে ঘুষের টাকা, পারিবারিক অনুষ্ঠানে ছাগল পাঠানো, ঈদ উপহার প্রদানসহ- নানান মুখরোচক গল্প স্থানীয় পর্যায়ে প্রচারিত আছে।

এছাড়া শফিউল আলম সমিতির সম্পাদকের জাল স্বাক্ষর সৃজন, ৯০ লাখ টাকার সম্পত্তি এবং ১২ লাখ টাকার অর্থ পাচার ও আত্মসাতের তথ্য গোপন, মামলা হতে সভাপতিকে দায়মুক্তির সুযোগ সৃষ্টি, পেশাগত অযোগ্যতা ও গুরুতর অসাধারচারণ, তদন্ত কার্যক্রমে অভিজ্ঞতা, সক্ষমতা ও প্রজ্ঞার অভাবের পরিচয় দিয়ে অপেশাদার ও অযোগ্য কর্মকর্তার পরিচয় দিয়েছেন। অনিয়মের মতো জাতীয় ইস্যু, অর্থপাচার ও আত্মসাতের মতো রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং দুর্নীতির মতো বৈষয়িক সমস্যার সঙ্গে তিনি প্রবলভাবে সম্পৃক্ত। পেশাগত অক্ষমতার কারণে ৬ মাস পূর্বে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত মো. শফিউল আলমকে ‘শো কজ’ করা হয়। পাশাপাশি দুর্নীতির তদন্তও চলছে।

বৈষম্যের শিকার বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী সমিতির সদস্য উম্মে আয়মন দৈনিক বাংলাকে বলেন, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গডফাদার সমিতির সভাপতি শামসুল হুদা এতদিন দলীয় সন্ত্রাসীদের নিয়ে অত্র এলাকায় সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য কায়েম করে। শত শত পাওয়ার অব এটর্নীর নামে বেআইনিভাবে জমি বিক্রি ও দখল করে। সিডিএ লে-আউট প্ল্যানভুক্ত রাস্তা, ইদগাঁ, গ্রিন জোন, স্কুল এমনকি মসজিদের জায়গাও এ ভুমিদস্যুদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।

ভুক্তভোগী প্রবাসী পরিবারের সদস্য কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম ৫ আগস্টের পর সকল অনিয়ম-দুর্নীতির অবসান ঘটবে, আমরা ন্যায় বিচার পাব। কিন্তু সমবায়ে অভিযোগ করার পরও আমরা ন্যায়বিচার হতে বঞ্চিত।’

অপর ভুক্তভোগী ইফতেখার উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘আমার মা মরহুমা জাহানারা বেগম সমিতির সদস্য ছিলেন। মায়ের মৃত্যুর পর সমিতির সভাপতি আর্থিক সুবিধা নিয়ে ভুয়া নমিনির কাগজ সৃষ্টি করে তার নামে বরাদ্দকৃত জমি ৬ ওয়ারিশের মধ্যে আমমোক্তারনামা না করে একজনের নামে দিয়েছে। এ ব্যাপারে আমি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্বায়িত্ব গ্রহণের পরপরই সমবায় দপ্তরে অভিযোগ দায়ের করি। কিন্ত তদন্তের নামে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে।’

উল্লেখিত অভিযোগের বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমবায় দপ্তরের যুগ্ম নিবন্ধক (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ মাহবুবুল হক হাজারী বলেন, চৌধুরীনগর সমিতির অনিয়ম-দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ পেয়ে ৪৯ ধারায় তদন্তে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। আমরা দ্রততম সময়ের মধ্যে এ ভুক্তভোগীর সমস্যা সমাধানের উদ্যেগ নিচ্ছি।