[ অনলাইন ] 15/07/2025
| |
|
সমস্যা কাটিয়ে আমানত সংগ্রহে চমক ইউসিবির
|
|
|
* গত ৬ মাসে ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে ৭ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা, তাতে তারল্যসংকট দূর হয়েছে।
* মূলধন বাড়াতে বিদেশি বিনিয়োগকারী খুঁজছে ব্যাংকটি।
সানাউল্লাহ সাকিব:
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাতেও পরিবর্তন আসে। আগের পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির পাশাপাশি বড় ধরনের অর্থ পাচারের অভিযোগ ওঠে। দেশি-বিদেশি অনেক গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। ফলে ব্যাংকটি ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে।
এ কারণে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যাংকটি থেকে বড় অঙ্কের অর্থ উত্তোলন করে নেয় বেশ কয়েকজন করপোরেট গ্রাহক। ফলে ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদামতো নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) করতেও ব্যর্থ হয়।
ব্যাংকটি শুধু তারল্যসংকট থেকেই ঘুরে দাঁড়ায়নি, গ্রাহকের আস্থাও বেড়েছে ব্যাংকটির প্রতি।
তবে নতুন পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের নানা পদক্ষেপে ব্যাংকটি কয়েক মাসের মধ্যেই সেই সংকট কাটিয়ে উঠে। ব্যাংকটি শুধু তারল্যসংকট থেকেই ঘুরে দাঁড়ায়নি, গ্রাহকের আস্থাও বেড়েছে ব্যাংকটির প্রতি। এ কারণে আমানতে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধিও হয়েছে। গত ৬ মাসে (জানুয়ারি-জুন) ব্যাংকটিতে ৭ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা নিট আমানত বেড়েছে। জমা হওয়া নতুন আমানত থেকে এ সময়ের মধ্যে তুলে নেওয়া আমানত বাদ দেওয়ার পর নিট এই আমানত পেয়েছে ব্যাংকটি।
ইউসিবির কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকটির প্রতি গ্রাহকের আস্থা বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন আমানত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। অল্প সময়ে আমানত সংগ্রহে ভালো সাফল্য পাওয়ায় ব্যাংকটির নতুন পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এখন ব্যাংকের মূলধন বৃদ্ধিসহ বড় ধরনের প্রবৃদ্ধির পরিকল্পনা করছেন।
ইউসিবি সূত্র জানায়, ১৯৮৩ সালে ইউসিবি প্রতিষ্ঠার সময় থেকে ব্যাংকটির সঙ্গে যুক্ত ছিল ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আরামিট গ্রুপ, পারটেক্স গ্রুপ ও অনন্ত গ্রুপ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিন দশকের বেশি সময় প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তারা ঘুরেফিরে ব্যাংকটির নেতৃত্ব দেন। তখন পর্যন্ত ব্যাংকটিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়। ২০১৮ সালে পারটেক্স গ্রুপের প্রতিনিধিদের ইউসিবি ব্যাংক থেকে বের করে দিয়ে ব্যাংকটির পুরো নিয়ন্ত্রণ নেয় আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরীর ছেলে সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁদের পরিবার। সাইফুজ্জামান চৌধুরী আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিমন্ত্রী হওয়ার পর ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তাঁর স্ত্রী রুকমিলা জামান। এই সময়ে ব্যাংকটির ঋণে বড় ধরনের নানা অনিয়ম ঘটে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইউসিবির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চেয়ারম্যান হিসেবে ব্যাংকটির দায়িত্ব নেন ব্যাংকটির অন্যতম উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শরীফ জহির। এরপর ব্যাংকটির এমডি কানাডায় চলে গেলে নতুন এমডি হিসেবে দায়িত্ব নেন মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ। তাঁরা ব্যাংকটিকে সমস্যা থেকে বের করে এনে সামনে এগিয়ে নিতে নানা উদ্যোগ নেন। ফলে ব্যাংকটির নানা সূচকে উন্নতি ঘটে।
ব্যাংকটির তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের শেষে ইউসিবির আমানতের পরিমাণ ছিল ৫৫ হাজার ৪২২ কোটি টাকা, যা গত জুন শেষে বেড়ে দাঁড়ায় ৬৩ হাজার ২০৪ কোটি টাকায়। এর মধ্যে শুধু জুন মাসেই আমানত বেড়েছে ২ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির ঋণ ছিল ৫৭ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা, যা গত জুনে বেড়ে হয়েছে ৬০ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ৬ মাসে নিট আমানত বেড়েছে ৭ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা ও ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা। তাতে ব্যাংকটির ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৮৭ শতাংশে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে এডিআর ছিল ৯২ দশমিক ৫ শতাংশ ও ডিসেম্বরে ৯১ দশমিক ৩ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এডিআর ৮৭ শতাংশের মধ্যে রাখতে হয়।
ব্যাংকটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ছয় মাসে ব্যাংকটির আমানত প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে খুচরা গ্রাহকেরা। বাড়তি আমানতের মধ্যে খুচরা গ্রাহকদের আমানত ছিল ৫৬ শতাংশ, করপোরেট গ্রাহকদের ৩২ শতাংশ ও এসএমই গ্রাহকদের ১২ শতাংশ। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ আমানত কম সুদের।
তবে আওয়ামী লীগ আমলে দেওয়া অনেক ঋণ খেলাপি হতে শুরু করেছে। এ কারণে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৫ শতাংশে। ২০২৩ সাল শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ছিল ৭ শতাংশের মধ্যে।
এদিকে ব্যাংকটির মূলধন দ্বিগুণ করার উদ্যোগ নিয়েছে নতুন নেতৃত্ব। এ জন্য রাইট শেয়ার ও নতুন শেয়ার ইস্যুর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। নতুন শেয়ার ইস্যুর জন্য বিদেশি কৌশলগত বিনিয়োগকারী খুঁজছে ব্যাংকটি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকটির এমডি মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ভালো আমানত আসছে, ধীরে ধীরে ঋণও বাড়ানো হচ্ছে। ব্যাংকের মূলধন ভিত্তি শক্তিশালী করার পাশাপাশি আমরা নতুন করে ব্যাংকটিকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছি। সব ধরনের আর্থিক পণ্য ব্যাংকে যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাতে গ্রাহক তাঁদের প্রয়োজনীয় সব ধরনের আর্থিক সেবা পান।’ |
|