শেরপুর সদর উপজেলার কুসুমহাটি বাজার কৃষি ব্যাংক শাখার ঋণ কর্মকর্তা শামসুন্নাহার আশার বিরুদ্ধে কৃষিঋণের অর্থ আত্মসাৎ এবং প্রতারণার অভিযোগে সাধারণ জনগণের তোপের মুখে পড়েছেন তিনি। ২০ জুলাই (রবিবার) দিনভর উত্তেজনার পর গভীর রাতে পুলিশ ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় তাকে উদ্ধার করা হয়।
জানা যায়, ওই দিন বিকেল থেকে রাত ১টা পর্যন্ত গ্রাহকদের একটি ক্ষুব্ধ দল ব্যাংকের ভেতরে কর্মকর্তা শামসুন্নাহার আশা, ব্যবস্থাপক মো. দেলোয়ার ও অন্যান্য কর্মীদের অবরুদ্ধ করে রাখে। ঘটনাস্থলে পৌঁছে পুলিশের সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
আগের অনিয়ম ও তদন্ত
২০২৪ সালের ২২ ডিসেম্বরেও একই শাখায় তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠে। তৎকালীন ব্যবস্থাপক মো. রফিকুল ইসলাম রুবেল এবং শামসুন্নাহার আশার বিরুদ্ধে তদন্তে প্রমাণিত অনিয়মের ভিত্তিতে পদাবনতি দেওয়া হয়। ২০২৫ সালের ২৩ জানুয়ারিতেও পুনরায় একই অভিযোগে শামসুন্নাহারের পদাবনতি হয় এবং বিভাগীয় তদন্ত এখনও চলমান রয়েছে।
দালালচক্র ও প্রতারণার অভিযোগ
স্থানীয় ভুক্তভোগী কৃষকরা অভিযোগ করেন, অশিক্ষিত ও অল্পশিক্ষিত কৃষকদের লক্ষ্য করে শামসুন্নাহার আশা দীর্ঘদিন ধরে একটি দালালচক্রের সহায়তায় প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা জানান, ইসমাইল হোসেন নামে এক দালালের মাধ্যমে ঋণ মঞ্জুর করা হতো। এছাড়া ঋণের অর্থ গ্রাহকরা সরাসরি ব্যাংক থেকে না পেয়ে, ওই কর্মকর্তার নিজ বাড়ি (শ্রীবরদী) থেকে আনতে বাধ্য হন।
লিখিত অভিযোগ ও ভুক্তভোগীদের বক্তব্য
২০২৫ সালের জুনে বলাইচর ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন কৃষক ব্যাংক ব্যবস্থাপক ও জেলা ডিজিএম বরাবর লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগকারীদের মধ্যে ছিলেন—মোছা. খাদিজা খাতুন, মো. মোস্তফা মিয়া, মো. হাজক মিয়া এবং আব্দুল করিম।
খাদিজা খাতুন বলেন, “আমার নামে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হলেও পরবর্তীতে জানতে পারি আমার নামে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ ছাড় হয়েছে।”
মোস্তফা মিয়া বলেন, “আমি জানতাম ২ লাখ টাকা ঋণ পেয়েছি, অথচ ব্যাংকে গিয়ে দেখি ঋণ দেওয়া হয়েছে আড়াই লাখ টাকা।”
হাজক মিয়া জানান, “আড়াই লাখ টাকা মঞ্জুর হলেও হাতে পেয়েছি মাত্র ১ লাখ ৫৫ হাজার।”
আব্দুল করিম দাবি করেন, “আমি ভেবেছিলাম ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি, পরে জানতে পারি ১ লাখ ১০ হাজার টাকা ছাড় হয়েছে।”
বদলি ও তদন্ত কার্যক্রম
এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শামসুন্নাহার আশাকে নেত্রকোনার হরিণপুর বাজার শাখায় বদলি করা হয়। তবে বদলির পরও তিনি ‘ফাইল বুঝিয়ে দেওয়ার’ অজুহাতে সাত দিন ধরে কুসুমহাটি শাখায় অবস্থান করছিলেন।
২০ জুলাই ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা টাকা ফেরতের দাবিতে ব্যাংক ঘেরাও করে অবস্থান নেয়। টাকা ফেরত না পেয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত তারা কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে রাখে।
জেলা কৃষি ব্যাংকের ডিজিএম আনন্দ মোহন গোপ জানান, “শামসুন্নাহারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত ও অডিট চলছে। এসব অভিযোগ ইতিমধ্যে সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে, তারা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।”
উদ্ধার ও ক্ষতিপূরণ
রাত সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশ ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যস্থতায় মুচলেকার মাধ্যমে শামসুন্নাহারকে উদ্ধার করা হয়। ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপক দেলোয়ার হোসেন জানান, “অভিযোগ পাওয়ার পর শামসুন্নাহারের কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা উদ্ধার করে ভুক্তভোগীদের ফেরত দেওয়া হয়েছে। আরও ৬০ হাজার টাকা পরিশোধের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে অভ্যন্তরীণ অডিট শুরু হয়েছে। অনিয়ম প্রমাণিত হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনার মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের মাঝে কৃষি ব্যাংকের প্রতি আস্থা হ্রাস পেয়েছে বলে জানান অনেকেই। ব্যাংক কর্মকর্তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।